যশোর: নূরজাহান আক্তার খুশি (২৮)। জন্ম থেকেই তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী।
দু’পায়ের হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে শহরের আর্ট ও রিসার্চ সেন্টার ‘চারুপীঠে’ এসেছেন সূচিশিল্প প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। পরম একাগ্রতায় নিজের মনের সৌন্দর্য সুই-সুতোর জালে বুনে যাচ্ছিলেন।
তার সেই কাজ খুবই আগ্রহভরে দেখছিলেন জাপানিজ কালচারাল অ্যাকাডেমির প্রিন্সিপাল ইয়ানো রিকো। তার সঙ্গে ছিলেন কপোতাক্ষ-জাপানের অর্গানাইজার ফাং ইয়াং জো এবং সদস্য হিরোমি। তারা সবাই ভূয়সী প্রশংসা করলেন সুমির হাতের কাজের।
যশোর শহরতলীর ধর্মতলা খোলাডাঙ্গা এলাকার রবিউল ইসলামের তিন সন্তানের মধ্যে বড় খুশি। নিজে নিজে শিখেছেন যশোর স্টিচ, নকশিকাঁথা স্টিচ, ডালফোঁড়, ভরাট, জামদানি, শ্যাডো, শান্তিপুরী স্টিচসহ নানান সেলাই। বাড়িতে বসেই কাজ করেন, নিজের হাতখরচও আসে সেলাই থেকে।
গত ১৪ মার্চ প্রথম পর্বে তিনি ছাড়াও সেলাই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন ১০৫ প্রতিযোগী। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পর্যায়ে এসেছেন ৩০ জন। তাদের ভেতর থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবেন ১০জন।
এবারের প্রতিযোগিতায় মেয়েদের পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন সাইফুল ইসলাম ও মেহেদি হাসান নামে দুই কলেজছাত্র। শতাধিক প্রতিযোগীর মধ্যে তারা দুজনই শুধু ছেলে! আর দুজনই দ্বিতীয় পর্বে মনোনীত হয়েছেন।
তাদের শিক্ষাগুরু শেলি খান। যিনি নিজে এসব কাজ করান গ্রামে গ্রামে মেয়েদের দিয়ে।
যশোর সদরের পুলেরহাট এলাকায় বাড়ি শেলি খানের। স্বামী ইমামুল হোসেন প্রবাসী। ছেলে মেহেদি হাসান উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র।
সাইফুল ইসলামের বাড়ি রূপদিয়া গ্রামে। তিনি রুদ্রপুর মুক্তিযোদ্ধা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন।
শেলি খান জানান, ‘স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে স্টিচের কাজ শেখেন তিনি । এখন নিজেই গ্রামে গ্রামে মেয়েদের দিয়ে সেলাইয়ের কাজ করান এবং সেগুলো বাজারজাত করেন। ’
ছেলে মেহেদি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার আগেও সে গোপনে সেলাই করতো। সেলাই ছাড়া অন্য কোনো নেশা নেই তার। সেলাইয়ের কাজ করে তার অ্যাকাউন্টে এখন প্রায় ৩৫ হাজার টাকা জমা হয়েছে। ’
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ার আগ্রহ রয়েছে মেহেদি হাসানের।
গ্রামে কাজ করতে গিয়ে শেলি খানের সঙ্গে পরিচয় সাইফুল ইসলামের। সেলাইয়ে আগ্রহ দেখে তাকে শেখান কীভাবে সুই-সুতোর বন্ধনে গড়ে ওঠে এ শিল্প। সাইফুল সূচিশিল্প প্রতিযোগিতায় গতবারও এসেছিলেন। ২৫ জনের মধ্যে ১২তম স্থানে ছিলেন। এবার তিনি আরও অভিজ্ঞ, আশা করছেন ভাল অবস্থানে থাকার।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শিখেছি যশোর স্টিচ, নকশিকাঁথা স্টিচ, ডালফোঁড়, ভরাট, জামদানি, শ্যাডো, শান্তিপুরী স্টিচসহ নানান সেলাই। বাড়িতে বসেই কাজ করি। হাতখরচও আসে সেলাই থেকে। ’
১৪ মার্চ সকালে তৃতীয়বারের মতো যশোরে শুরু হয় সূচিশিল্প প্রতিযোগিতা। দ্ই বছর ধরে এ প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে। চারুপীঠ ও ফোঁড় ক্রাফটস যৌথভাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। আর প্রতিযোগিতায় অর্থসহায়তা দিচ্ছে কপোতাক্ষ-জাপান।
চারুপীঠের অধ্যক্ষ ও আয়োজক মাহবুব জামাল শামীম বলেন, ‘১৯৭১ সালের আগে আমাদের মা-বোনেরা তাদের শাড়ির পাড় থেকে নানারঙের সুতো তুলে সেলাই করতেন কাঁথা, ওয়ালমেট, কুশনসহ আরো নানা জিনিস। অনেক আগে থেকেই নকশি সেলাই সামাজিকভাবে রূপ নেয় অদ্ভুত এক শিল্পের। মা-বোনেরা ভাবতেন, অতিথি আসবেন তাদের বসতে দিতে হবে, খেতে দিতে হবে-তার জন্য প্রয়োজন নান্দনিক সেইসব কাজের। ’
‘যুদ্ধপরবর্তীকালে ভারতীয় প্রিন্টকাপড়ে সয়লাব হয়ে যায় দেশ। কাপড়ের পাড় থেকে আর আহরণ করা যায় না রঙিন সুতো, মা-বোনেরা ভুলতে বসেন সেই আদি অকৃত্রিম শিল্পকে। পরে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এ শিল্পরক্ষার্থে। ’
তিনি বলেন, ‘শিল্পকলার সামাজিকীকরণের মাধ্যমে আজ সেলাই হয়ে উঠেছে জীবিকার মাধ্যমও। ’ যশোরের নকশিকাঁথা বা সেলাই আজ দেশের বাইরেও বিস্তৃত। সেই ঐতিহ্যকে রক্ষা খুব সহজ নয়। তবুও প্রচেষ্টা চলছে-এটাই বা কম কী ’- বললেন তিনি।
ফোঁড় ক্রাফট্স-এর নির্বাহী পরিচালক মামুনুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক আমাদের সূচিশিল্প। আবহমানকাল থেকে আমাদের মা-বোনেরা তাদের নিপুণ হাতে কাঁথা, রুমাল, বালিশের কভার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়েও তুলে এনেছেন সেই শিল্পকর্ম। তাদের সেই কৃতিত্বটুকুর মর্যাদা সমুন্নত রাখা, একাজে উৎসাহ যোগাতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস। ’
তিনি বলেন, ‘চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা থেকে নির্বাচিত হবেন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়সহ ১০ জন। যাদের প্রত্যেককে নগদ অর্থসহ সম্মাননা স্মারক ও সনদপত্র দেওয়া হবে। ’
শুক্রবার (২৩ মার্চ) যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে (বিডি হল) অনুষ্ঠেয় সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার উপস্থিত থাকবেন বলে আয়োজকরা জানান।
এছাড়া জাপানিজ কালচারাল অ্যাকাডেমির প্রিন্সিপাল ইয়ানো রিকো, কপোতাক্ষ-জাপানের অর্গানাইজার ফাং ইয়াং জো এবং সদস্য হিরোমি এবং নাট্যব্যক্তিত্ব শহিদুল ইসলাম সাচ্চু উপস্থিত থাকবেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১২
সম্পাদনা: রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর