ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

নৃত্যগীতের মুর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছিল মণিপুরী রাসলীলায় 

ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২২
নৃত্যগীতের মুর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছিল মণিপুরী রাসলীলায়  মণিপুরী রাসলীলার দলগত নৃত্য। ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: সঙ্গীত আর নৃত্যে ভরে উঠেছিল পূর্ণিমারাত। শিল্পীদের আপন সঙ্গীত আর নৃত্যশৈলীর প্রতি পর্বে পূর্ণতা পেয়েছিল মণিপুরীদের সবচেয়ে বড় এ আয়োজন।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মণিপুরী মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসব।

মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের ১৮০তম এবং আদমপুরে মৈতৈ সম্প্রদায়ের ৪০তম মহারাসলীলা উৎসব। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানা শ্রেণী-পেশার হাজারো মানুষের সমাবেশ ঘটে। মণিপুরী ছাড়াও এ অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। যা দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় জমিয়েছে দুই মণ্ডপজুড়ে।

বেলা ১১টা থেকে শুরু হয় রাস উৎসবের প্রথম পর্ব রাখাল নৃত্য বা গোষ্ঠলীলা। এই পর্বে মূলত শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলার বিভিন্ন কাহিনি নৃত্য-গানে প্রদর্শিত হয়। রাখাল নৃত্য সকালে শুরু হয়ে চলে গোধূলি পর্যন্ত। শ্রীকৃষ্ণ বাল্যকালে গরু চড়াতেন। তাই মণিপুরী তরুণদের রাখাল বেশে এই রাখাল নৃত্য বা গোষ্ঠলীলা।

মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘ, জোড়ামণ্ডপ, শিববাজার, কমলগঞ্জের আয়োজনে ১৮০তম শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি।

গেস্ট অফ অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি এবং মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির  সদস্য এবং  নেত্রকোনা-৩ আসনের এমপি অসীম কুমার উকিল।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) সুদর্শন কুমার রায়।

কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রফিকুর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রকৌশলী যোগেশ্বর চ্যাটার্জি, সভাপতি, মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘ।

মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, এই মণিপুরী মহারাসলীলাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- গভীর রাতে শুরু হয় মূলপর্ব রাসনৃত্য। গোধূলি পেরিয়ে হেমন্তের রাতে দ্বিপ্রহরের চাঁদ। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথি। ধবল জ্যোৎস্নায় মন্ডপগুলো উদ্ভাসিত। ঠিক সে সময় কৃষ্ণরূপে বাঁশি হাতে উপস্থিত হন এক কিশোর। অপরূপ সাজে রাধা আর গোপী বেশে মণিপুরী তরুণীদের আবেগী ঢঙে শুরু হয় রাসনৃত্য। সেই সাথে মণিপুরী বন্ধনাগীতি। রাতভর চলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি। ভোররাতে শ্রীকৃষ্ণের বিদায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মনিপুরি তরুণ-তরুণীরা। সবাই ফিরে আসেন নিজ নিজ ঘরে। এভাবেই উদযাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসব।

রাসলীলায় গোপীগণকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে বিমুগ্ধ বিহার, যমুনা পর্ব, কৃষ্ণের অন্তর্ধান। গোপীবধূ আর কৃষ্ণের পদচিহ্ন ধরে একাকী রোদনরত গোপীবধুকে খুঁজে পাওয়া। কৃষ্ণ বিরহে ব্রজগোপীগণের রোদন। বিরহকাতর চিত্তে ১১টি শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতিবন্দনা  করা হয়। কৃষ্ণের বিচিত্র মহিমা শক্তির স্তুতিগীত পরিবেশিত হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে মণিপুরীরা প্রথম রাসলীলা পালন করেন। সে সময় মণিপুরী রাজা স্বপ্নাদীষ্ট হয়ে কন্যা লাইরোবিকে রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাস অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেন। মৈথিলি ও ব্রজবুলি ভাষার বিভিন্ন পদের মণিপুরী সংগীতের নিজস্ব গায়কী ও মুদ্রা-পদবিক্ষেপে জটিল এবং ধ্রপদি ধারার গীতি-নৃত্যধারায় তা পালন করা হয়েছিল।

মণিপুরীদের আদিভূমি ভারতের মণিপুর থেকে এই রাস উপমহাদেশে তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হলেও এর নৃত্যশৈলী বরাবরই সব ধর্ম ও জাতির মানুষকে আকর্ষণ করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২২ 
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।