ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

অসচরাচর | অমিতাভ পাল

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বোমার বস্তাটা কাঁধে নিয়ে সেতুর ধার দিয়ে তরতর করে নেমে গেলাম খালের জলে। আমার পরিকল্পনা ছিল সেতুর মাঝখানের দুইটি পিলারে এবং দুই প্রান্তের জোড়ায় বোমা বসানো।

তারপর একযোগে বোমাগুলিকে ফাটিয়ে দিলে সেতুটা মাঝখান থেকে ভেঙে পড়বে—এটাই ছিল আমার প্রশিক্ষকের ধারণা।

প্রশিক্ষকের কথামতোই সেতুর মাঝখানের পিলার দুইটিতে দুইপ্রস্থ বোমা বসালাম। তারপরই শুরু হলো আমার অভিযানের সবচেয়ে লোমহর্ষক এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্ব—সেনাশিবিরের প্রান্তের জোড়ায় বোমাস্থাপন। লোমহর্ষক এইজন্যই—কারণ অনুজ্জ্বল হলেও একটা আলোর স্লিপ এসে পড়েছিল জোড়ার জায়গাটাতে। এই আলোটা ছিল সেতুটাকে পাহারা দেবার কাজে নিয়োজিত। কোনোকিছু দেখতে পেলেই যেন সে চেঁচিয়ে উঠবে প্রাণপণে। ডেকে আনবে শিবিরের সৈন্যদের। মফস্বল শহরের এমনিতেই গাঢ় অন্ধকারে ওই অনুজ্জ্বল আলোটাও জ্বলছিল একটা সার্চলাইটের মতো। তার ধাঁধানো উপস্থিতি আমাকে থমকে দিল কিছুক্ষণের জন্য। ভেজা শরীরে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম সেতুর নিচের খালের পারের নরম মাটিতে।

থমকে যাওয়ায় এই ঘটনাটা একদিক থেকে সুফলই বয়ে আনল আমার জন্য। পিলারের বোমা বসানো শেষ হবার পর একটা তাড়াহুড়া যেন পেয়ে বসেছিল আমাকে। তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে চাইছিলাম বাকি কাজটুকু। এতে হাঁটাচলার বাড়তি কিছু শব্দ উৎপাদিত হচ্ছিল। সেনা শিবিরের কাছাকাছি থাকার সময় এই শব্দ সৈন্যদের মনযোগ আকর্ষণ করতে পারত। তাতে মনোযোগের ফাঁদে আমি যদি ধরা পড়তাম—তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। প্রথমত প্রাণটাকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতাম এবং দ্বিতীয়ত অপারেশনটা ভণ্ডুল হতো। এ পর্যন্ত যে দুই জায়গায় বোমা বসিয়েছি—সেই দুই বোমাকে সৌভাগ্যক্রমে যদি ফাটাতেও পারতাম তাতে সেতু ধ্বংস হতো না। বড়জোর পিলার দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য একটু হয়ত টলত। সেটা মেরামত করে নিয়ে সেতুটাকে আবার ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে সৈন্যদের বেশি সময় লাগত না। সবচেয়ে সমস্যা হতো আমাদের পক্ষের। এবারের এই ব্যর্থতায় শত্রুসৈন্যরা সতর্ক হয়ে প্রহরা এমন নিশ্ছিদ্র করে তুলত যে আরেকবার সেতুটাকে ধ্বংস করা অসম্ভব হয়ে পড়ত। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে দেশে ঢুকতে বাঁধা পেত। যুদ্ধের গতিই যেত পাল্টে।

সামান্য এই শব্দবৃদ্ধির জের যে কত গভীর—থমকে দাঁড়িয়ে তাই ভাবছিলাম। এমন সময় দেখলাম ছাউনি থেকে একটা সৈন্য বেরিয়ে সেতুটার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর সে শুরু করল প্রশ্রাব করতে। সশব্দ প্রশ্রাবের সেই ধারা জলপ্রপাতের মতো পড়তে শুরু করল খালের জলে। তবে সেই শব্দময় পতন ছিল আমার বিপরীত দিকে ফলে চোখে পড়া ও ভিজে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। সৌভাগ্য কিনা জানি না, তবে এই ঘটনাটা আমার প্রকল্প বাস্তবায়নে সাহায্যেই করেছিল।

প্রশ্রাব শেষে সৈন্যটা ভালো করে চারপাশ দেখল একবার। তারপর ফিরে চলল ছাউনিতে। আমিও আর দেরি না করে সেতুর জোড়ায় বোমা বসানো শুরু করে দিলাম। কাজটা শেষ করে যখন আবার ফিরে এসেছি উল্টা দিকের পারে—কিছুটা স্বস্তি যেন অনুভব করল মন। বলা যায় কাজটার সিংহভাগ শেষ করে ফেলেছি। এখন শেষ বোমাটা বসিয়ে তারগুলিকে একসঙ্গে যুক্ত করে ডিটোনেটরের সঙ্গে জুড়ে দিলেই আমার মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর একটা আক্রোশভরা থাবা নিয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ব ডিটোনেটরের বোতামের ওপর। পরক্ষণেই বিস্ফোরিত হওয়া বোমার শব্দ নিশ্চয়ই শান্তি বর্ষণ করবে আমার মনে। পাকিস্তানিরা আমার নিরীহ সঙ্গীদের হত্যা করার পর থেকে আমার মনে কোনো শান্তি নেই।

শেষ বোমা বসানোর  কাজটা খুব সহজেই শেষ করে ফেললাম। তার জোড়া দিতেও দেরি হলো না। হঠাৎ মনে হলো বোতামটা টেপার আগে সৈন্যগুলিকে একবার জানিয়ে দেই কী করতে যাচ্ছি। নাহ, কাজটা ঠিক হবে না বলে প্রথমেই বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করল আমার মনের একটা অংশ। তার প্রধান যুক্তি ছিল আমার নিরাপত্তাকে নির্ভর করে। বোমা ফাটানোর পর প্রকল্পের সফলতার সংবাদ নিজেদের শিবিরে পৌঁছে দেওয়াটাও আমার কর্তব্যের একটা অংশ। শত্রুদের জানিয়ে দেয়ার যে হঠকারী সিদ্ধান্ত এখন আমি নিতে যাচ্ছি—তা করলে কাজের এই শেষ অংশটুকু করা তো সম্ভব হবেই না বরং প্রাণ নিয়ে ফেরাটাও দুষ্কর হয়ে পড়বে। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর সেতু ওড়ানোর ব্যাপারে আমাদের দলের একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি আমি। দল চায় আমাকে দিয়ে আরো সেতু ওড়াতে। প্রথম কাজটাতেই যদি আমি নিহত হই—দলের একটা বিরাট লোকসান হয়ে যাবে। আর জানাতে চাওয়ার যে ব্যাপারটা—সেটা তো বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্পন্ন হবে। তখন কেউ জানতে না চাইলেও সে বাধ্য হবে জেনে ফেলতে। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় এই কাজটি আমার না করলেও চলে বলে জানিয়ে দিল মনের যুক্তিনির্ভর অংশটুকু।

ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিকই। কিন্তু বীরত্ব প্রদর্শনের যে আকাঙ্ক্ষা এতক্ষণে মনে মধ্যে স্তূপ হয়ে জমে উঠেছে—সে এত সহজেই হার মানতে চাইল না। বোমার খবর সৈন্যদের জানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জেদ প্রকাশে যদিও ইস্তফা দিল কিন্তু সাথে সাথেই আরেকটা বিকল্প রাস্তা অবলম্বন করার জন্য আমাকে পাগল করে তুলল। এই পথটা হলো নিজেকে প্রদর্শনের পথ। অর্থাৎ বোমাটা ফাটিয়ে দেবার পর তার শব্দে আকৃষ্ট হয়ে যখন সৈন্যরা বেরিয়ে আসবে তাদের ছাউনি থেকে, সে সময় আমি যেন সেতুর এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তাদের জানিয়ে দেই—কে এই সর্বনাশটা করল। ততক্ষণে সেতু ভেঙে পড়ার জন্য সৈন্যরা আমাকে তাড়া করতে পারবে না। আর এর ফলেই পেছনের দিগন্ত বিস্তৃত ঘন অন্ধকারের মধ্য লুকিয়ে পড়তে আমার কোনো অসুবিধাই হবে না। এখানে আমি যে একাই এসেছি বোমা ফাটাতে এটা তো আর পাকিস্তানিরা জানে না। ফলে তারা আমাকে ধরবার ব্যাপারেও সাহসী হবে না আমার সঙ্গীসাথী ও গাঢ় অন্ধকারের ভয়ে।

প্রস্তাবটা আমার বেশ মনঃপুত হলো। ভাবলাম এভাবেই জানাব ওদের। মনে কল্পনায় ভিড় জমাল আতশবাজির এক জমজমাট প্রদর্শনী। সত্যিই তো—এরকম বোমাবাজির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের সুযোগ ক’জনের হয়।

আমার হলো। বোতামটা টিপে দিয়েই এক অমানুষিক উল্লাসে উঠে দাঁড়ালাম আমি। চিৎকার করে চেঁচিয়ে ঘোষণা করলাম আমার বিজয় বার্তা। থুথু ছিটিয়ে দিলাম আমার মৃত সঙ্গীদের হত্যাকারীদের দিকে। বোমার আলো ও আগুনে তখন আমি উদ্ভাসিত এক নতুন নীরো।

হঠাৎ একটা গুলি ছুটে এলো আমার দিকে। স্পষ্ট দেখলাম গুলিটা আসছে একটা রাতের পাখির মতো নিঃশব্দে আর দূরে ওই পারে মুখে ভয়ের ঘাম মেখে দাঁড়িয়ে আছে একটা সৈন্য—এইমাত্র যার রাইফেল গর্ভধারীণির মতো আর্তনাদ করে প্রসব করেছে এ গুলিটাকে। গুলিটা এলো আর পরক্ষণেই উড়িয়ে নিয়ে গেল আমার মাথার খুলি। ’

কথাটা শুনেই রুদ্ধশ্বাস শ্রোতাবৃন্দ, যারা এতক্ষণ আশপাশের অন্ধকারের মতোই নীরবে শুনছিল গল্প, সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তারপর?’

ক্লান্ত হেসে ব্যথিত কণ্ঠে লোকটা বলল, ‘তারপর থেকে আমার আর মাথা নেই। ’



বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ