ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

প্রতিশোধ | সাজেদা হক

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৬
প্রতিশোধ | সাজেদা হক

প্রতিশোধ

হৃদয়। বগুড়ার শিবগঞ্জের বেতগাড়ীতে জন্ম।

পাতলা ফিনফিনে শরীর। গায়ের রং শ্যামলা। পর পর তিনবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কম্পার্টমেন্টালে পাশ করেছে। এটা ৯০ সালের কথা। গণিতে নম্বর গ্রেস পেয়ে কোনোমতে তৃতীয় দফায় এসএসসি সার্টিফিকেটটা সংগ্রহ করেছে সে। ভর্তি হয়েছে একাদশ শ্রেণিতে। এখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

বাবা-মাসহ দুই ভাই, এক বোনের সংসার হৃদয়ের। বাবা অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। বাবার নাম বক্কর আলী। অষ্টম শ্রেণি পাস। বিয়ের পর বড় শ্যালকের চেষ্টায় সেনাবাহিনীতে কাজ জুটিয়েছিলেন। সেটাই সম্বল ছিলো। আয়ের একমাত্র পথও।

হৃদয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মা মমতা। পোলিও আক্রান্ত হয়ে এক পা খুড়িয়ে চলেন তিনি। কিন্তু দারুণ পরিশ্রমী। বলা চলে হৃদয়দের সংসারটা টিকে আছে এই পোলিও আক্রান্ত একটু খোড়াটে মায়ের জন্যই। বছরে কখনই সবজি কিনতে হয়নি হৃদয়দের। বাড়িতেই হাঁস-মুরগী পালন করেন তার মা। শুধু কি হাঁস-মুরগী, তিনি গরু-ছাগলও পালতেন। সেসব হাঁস-মুরগী যত ডিম দিতো তা বাড়ীর আমিষের চাহিদা মিটিয়ে কখনও কখনও প্রয়োজন পড়লে বিক্রিও করতেন তিনি।

এভাবেই টানাপোড়েনের সংসারে হৃদয় ভালোভাবেই জানতো তার পড়াশোনাটা কতটা জরুরি। তবুও কোনো এক অজানা কারণে হৃদয় পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারে না। অবশ্য এজন্য সে মাকেই দায়ী করে।

তখন মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পাশের বাসায় বেড়াতে আসা পলি মন কেড়ে নেয় হৃদয়ের। টানা টানা চোখ, অদ্ভুত ধূসর রং, স্লিম ফিগারের পলিকে এক নজর দেখেই ভালোবেসে ফেলে হৃদয়। আর ফেলবেই না কেন?

সেদিনের কথা এখনও চোখ বুঝলেই তার চোখের সামনে ফুটে ওঠে স্পষ্ট। কী মনে করে হঠাৎ ঘরের বাইরের দিকের জানালাটা খুলেছে হৃদয়, অমনি দারুণ এক সুবাস তার নাকে আসে। কোথা থেকে আসছে এ সুগন্ধি- ভাবতে ভাবতে সামনে চোখ গেলো হৃদয়ের। কলাগাছের দেয়া বেড়ার ফাঁক গলে হৃদয় দেখলো, এলোকেশী এক অপরূপা। ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার কেশ পরিষ্কার করছে। যখন তোয়ালে দিয়ে দুই হাত উপরে তুলে চুলে একটি একটি করে বারি মারছে, আর প্রত্যেকটা বারিতেই হৃদয়ের চোখ আটকে যাচ্ছে এই অপরূপার বক্ষের দিকে। সে যে কি দোলা। সেই দোলা দোল দিয়ে যায় হৃদয়ের অন্তরেও। আনমনে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ।

এলোকেশী, চিকন গড়ন আর মাতাল করা এ সুগন্ধিবাহী নারীকে তার চাই-ই চাই। স্থির করলো হৃদয়। জানালা খোলা রেখেই বের হলো বাড়ির বাইরে। হুট করেই সুন্দরীর সামনে গিয়ে হাজির। চাচী আম্মা, চাচী আম্মা বলে ডাকছে হৃদয়।
হৃদয়কে দেখে অনেকটাই অপ্রস্তুত সেই সুন্দরী। মনে হলো দৌড়ে পালালো। কিন্তু হৃদয় খেয়াল করলো, অন্য রুমে গেলেও মেয়েটিও হৃদয়কেই দেখছে।

চাচী বের হয়ে আসলো। হৃদয়ের এই চাচীটিও দারুণ সুন্দরী। তিন বাচ্চার মা, তবুও এমন সুন্দর মেয়ে হৃদয়ের চোখেই পড়ে না। চাচীর নামও আবার সুন্দরী। হৃদয়ের ডাক শুনে বের হয়ে এলো চাচী।
- কি বাপুই, তুই ডাকিছিস ক্যানে?
- এটা কায় চাচী?
- কায়... ও পলির কথা কহিছিস। আরে বাপুই, পলি তো মোর বড় ভাইয়ের বেটি। ক্যানে... কিছু কি করিছে পলি? অয় তো কেবল এইটে পড়ে।
- আরে না, চাচী একটা কথা মুই সাফ সাফ কহি দেও.... পলিকে হামার ঘরত তুলিম... কহি দিনু!

এবার হাহাহাহা করে অট্টহাসি দিয়ে চাচী সুন্দরী বলে ওঠেন, এই এক জ্বালা, ছাওয়াটা যেইঠে যায়, ওইঠে কোনা থাকিই শুরু। ছাওয়াটার রেহাই নাই।
- না, মোখে দিবারই নাগবে, মুই কোনো কথাই শুনিম না, কহি দিনু। বলেই একটা মাটির পিরিতে বসে পড়ে হৃদয়। এতক্ষণে একটু মাথাটা স্থির হয়েছে মনে হলো তার। সেই মাতাল করা সুবাসটার রেশ এখনো আছে।
- মোর কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু তোর মাও কি এতে রাজি হইবে বাপুই?
- সেটা মুই জানো না, পরে দেখা যাইবে, আপাতত এইটাই ফাইনাল, পলি মোর। আর কারো হবার নয়, ঠিকাছে?
- আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে... কিন্তু মোক এনা টাইম দে, মুই পলিক পোছো... ওর মত আছে কি নাই।
- কোনো টাইম দিবার পারিম না, মুই বসি আছু... তোমরা ওক পুছি আইসো।

পলি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। হৃদয়ের জোড়াজুড়িতে অনেকটা বাধ্য হয়েই পলি রাজি হয়। আর চাচী সুন্দরীর তদারকিতে প্রথম ভালোবাসা পূর্ণতা পায় হৃদয়ের। ঘন ঘন দেখা, সিনেমায় যাওয়া, ঘোরাঘুরি সবই চলে। এখন আর এক মুহূর্তও পলিকে ছাড়া থাকতে পারে না হৃদয়।   পলি প্রায় নিয়মিতই আসে সুন্দরী ফুপুর বাসায়। পলি না এলে তাদের বাড়ি পর্যন্ত চলে যায় হৃদয়ও।

প্রেমেরও নাকি অন্যরকম এক সুবাস আছে, তা নাকি ছড়িয়েও পড়ে দ্রুত- এটা টের পেতে বেশি সময় যায়নি হৃদয়ের। পলির লেখা একটি চিঠি হঠাৎ করেই হৃদয়ের মায়ের হাতে পড়ে। তাও আবার রক্ত দিয়ে লেখা পলির চিঠি। যেখানে স্পষ্ট করে লেখা, হৃদয়কে ছাড়া বাঁচবে না পলি।

আর যায় কই। সেবার পরীক্ষার ফলাফল কেন খারাপ হয়েছিলো, তার হিসেব মিলিয়ে ফেললো হৃদয়ের মা। এবার কড়া শাসনে হৃদয়। কোথায় যায়, কার সাথে মেশে সব হিসেব দিতে হয়। দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েও ফলাফল খারাপই হলো। অন্যদিকে পলিও ভুল বুঝতে শুরু করেছে। হৃদয়কে চাচীর মাধ্যমেই আরেকটি চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছে। এ বছর যদি সে বিয়ে করতে না পারে, তাহলে সে আর এই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখবে না।

হৃদয় পড়েছে মহা বিপদে। একদিকে মায়ের আলন্টিমেটাম, পাস না করলে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। অন্যদিকে, বিয়ে না করলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছে পলি। যাবে কই বেচারা। এবার গণিতে গ্রেস দিয়ে কোনোমতে পাস করলো। একাদশে ভর্তিও হলো। প্রথম বর্ষ পার হতে না হতেই হঠাৎ করে একদিন বাসায় এসে শুনলো তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তারই মামাতো বোনের সঙ্গে।

শুনে সাথে সাথে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো হৃদয়ের। ওর মামাতো বোন মানে মধু তো! হায় হায়। এটা কিভাবে সম্ভব? কোথায় মধু আর কোথায় পলি?

এছাড়াও, মধুর বাবাই বা রাজি হলো কিভাবে এটাও হৃদয়ের মাথায় আসে না। মা হারা মধু, দেখতে কালো, নাকটাও মোটা। চোখগুলো ছোট ছোট, দেখতে পায় কি না-সন্দেহ আছে হৃদয়ের। এমন একটা মেয়ের সাথে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে হৃদয়ের।

কান্না কি শুধু মধুর কথা ভেবে পাচ্ছে? কান্না পাচ্ছে মধুর বাবার কথা ভেবেও। জীবনে কতবার কতভাবে যে হৃদয়কে অপমান করেছে- তার ইয়ত্তা নেই। হৃদয়ের মামা ভীষণ রাগী মানুষ। তেমনি পরোপকারী, তেমনি পরিশ্রমী। সবার উপকার করেন তিনি কিন্তু কেবল হৃদয়ের বেলাতেই তার যত রাগ। কখনও নাম ধরে ডেকেছে কিনা মনে করতে পারে না হৃদয়। সব সময় কুষ্মণ্ডটা কই বলে ডাক দেন তিনি। অনেকটাই নির্দয় হৃদয়ের সাথে তার মামার আচরণ। কারণ জানে না সে।

এমনিতেই তো মামার বাসায় আসাই নিষেধ হৃদয়ের। একদিন তার মায়ের সামনেই মামা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন- দ্যাখ মমতা, মোর বেটি তিনটা, সবায় বড় হয়ছে, তোর ব্যাটা যেন ঘন ঘন মোর বাড়ি না আইসে। কোনো দরকার থাকলে দিনে দিনে আইসবে, দিনে দিনেই চলি যাইবে। মুই পিছনত কথা একদম পছন্দ করো না।
-এটা শুনে হৃদয় সেদিন মনে মনে হেসেছিলো, যে তিনটা বেটি... একটা কালি, একটা আটার বস্তা আর একটা এত কালো যে আছে তা বোঝাই যায় না। এমন মেয়েদের সাথে আবার মোর কিছু হইবে- এটা ভাবলেও খুবই অপমানিত বোধ করেছিলো সেদিন। হৃদয়কে কি চরিত্রহীন মনে করেন তার মামা? যে এখানে আসলেই তার বিদঘুটে টাইপ মেয়েদের বিপথে নিয়ে যাবেন।

আরো একদিনের অপমানের কথা কোনভাবেই ভুলতে পারে না হৃদয়। সেবার বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে। বেতগাড়ীতে কেবল ওর মামার বাসাতেই টিভি। তাই সে ভাবলো জীবনে একটা দিন সে মামার বাসায় থাকতে চাইবে। আর ফাইনাল ফুটবল ম্যাচটা দেখে যাবে। এসেছিলোও সে, রাত এগারোটা পর্যন্ত খেলা দেখেছেও। এতরাত হওয়ায় সে ভেবেছিলো, খেলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে পারছে সে। কিন্তু তার এই ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো বাঘ মামা।   মামা এসেই বলল, কি রে এখনো আছিস যে, যা তোর নানীর বাড়িত যায়া ঘুমা। রাইত অনেক হইছে। আর কোনো শব্দ বের করতে পারেনি হৃদয়। দুঃখে-কষ্টে অন্তর টুকরো টুকরো হয়েছে সেদিন।

সেই রাতে কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাড়ী ফিরে এসেছিলো আর প্রতিজ্ঞা করেছিলো, আর কোনদিন সে মামার বাড়িতে যাবে না। আর আজ কিনা সেই মামাই তার মেয়েকে তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো? মধুই বা রাজি হলো কিভাবে, কোনো হিসেবই মেলাতে পারছে না হৃদয়। কিন্তু মায়ের কথা মানে তো আইন। হাকিম নড়বে তবু হুকুম নড়বে না।

বিয়ের খবর শুনেই পলিও ছুটে এসেছে।   চাচী সুন্দরী ডেকেছে হৃদয়কে। পলি কোনো কথাই বলছে না, কেবলি কাঁদছে। আর নিরুপায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে হৃদয়। শুধু এটুকু বলল, আমাকে কয়েকটা মাস সময় দাও পলি। মা নিজেই তোমাকে ঘরে তুলে আনবেন। বলেই সেখান থেকে বের হয়ে এলো সে।

বিয়ে হওয়ার আগেই বিয়ে ভাঙার পরিকল্পনা করতে লাগলো হৃদয়। একটা জেদ মনের মধ্যে, মা ও মামার বিরুদ্ধে যুদ্ধ তার। পলির মতো অপরূপাকে ফেলে মা কোন হিসেবে মধুকে বিয়ে করতে বলতে পারে! মামা সব ভুলে গেলে, সে তো কিছুই ভোলেনি, এসব ভোলা যায় না।

এক বন্ধুকে ঠিক করলো, সে বিয়ের দিন একটা ছোট অঘটন ঘটাবে, যাতে করে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না- পরিকল্পনাটা এতোটাই নিখুঁত। যেমন পরিকল্পনা, তেমন কাজ।

বিয়ের দিন। মাত্র কাজী সই নিয়েছে মধু’র, অমনি কলের পার থেকে চিৎকার- ওরে মারে, ওরে বাবারে...

সব ছুটে গেলো কলের পাড়ে। কাহিনী কি জানতেই রাগে ফেটে পড়লো মধুর বাবা। মেয়েকে আর কোনোভাবেই হৃদয়ের কাছে দেবেন না তিনি। কারণ যে ছেলের বন্ধু বিয়ে বাড়িতে এসে মধুদের বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে, করতে পারে, সেই ছেলের আচরণ কেমন হবে? এমন ছেলের হাতে মেয়ে দিয়ে জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে চান না তিনি।

মামার এই সিদ্ধান্তে খুবই খুশি হৃদয়। এটাই তো চেয়েছে হৃদয়। প্রতিশোধটাও ঠিকমতো দেয়া হলো তাহলে শেষ-মেষ। মেয়ের বিয়ে দিলেন, কিন্তু শ্বশুর বাড়ি তার কপালে জুটলো না। এটা ভাবতে ভাবতেই খুশি মনে বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায় হৃদয়। বিয়ে করতে যে বাস নিয়ে এসেছিলো, ঠিক সেই বাসটার জন্য অপেক্ষা করছিলো।

বাসটা এসে তার সামনে দাঁড়ালো, সেও বাসে উঠলো। উঠেই তো চোখ ছানাবড়া, মধুকেও তো গাড়িতে বসা দেখছে সে। তার মানে এই মেয়ের হাত থেকে রেহাই হলো না এ দফায়। পাশে বসে মনে মনে ভাবলো, ঠিকা আছে, এ দফায় বাঁচলে কি? সুযোগ আরো আসবে।

বাড়িতে গাড়ি থেকে মধুকে নামিয়েই হৃদয়ের ওপর মায়ের তর্জন-গর্জন। রাগারাগি, সবাই কোনমতে থামালো। কিন্তু মজার বিষয় হলো, সেই রাতে আর বাসর ঘরে এলো না মধু। কেন এলো না, এটা জানার কোন আগ্রহ নেই হৃদয়ের। শুধু সেদিন নয়, পর পর সাত কিংবা আট রাত হবে কোনভাবেই রুমে আসে না মধু। এতে খুশি হয় হৃদয়। স্থানীয় এক নানীকে সে বলে বিষয়টা। একটু ঘুরিয়ে বলে এভাবে...
-নানী, মুই চাইলে কি হইবে, তোমার সুন্দরী নাত বউতো আর মোক পছন্দ করে না।
প্রতিবেশী নানী হলে কি হবে। ইনি আবার দারুণ প্রভাবশালী এই পরিবারে। যেই শুনেছেন নানী,  সেই রাতেই মধু হৃদয়ের ঘরে। কিভাবে কি করেছেন, কিছুই জানে না হৃদয়। হৃদয় আজ বিপদে... কিন্তু নিয়তি মনে করে মধুর সাথেই নতুন জীবন শুরু করলো সে। মনের মধ্যে বাস পলির, আর বাসর কাটালো মধুর সাথে।

মধু। তিন বোনের মধ্যে সবার বড়। গায়ের রং কালোই। মোটা নাক। মোটা গড়ন। কিন্তু ভীষণ মেধাবী। পড়াশোনার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ। আইনজীবী হতে চায়। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবারও বিয়ে করেন। মধুরা দুই বোন। সৎমায়ের এক মেয়ে হয়েছে। সাকুল্যে তিন বোন মধুরা।

এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সে। ফলাফল এখনও হয়নি। এর মধ্যেই বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয়েছে। ছোটবেলা থেকে দাদীর কাছে বড় হয়েছে। দাদী তার ঋণ পরিশোধ চায়। তার নাতি হৃদয়কে বিয়ে করলেই মধুর সব ঋণ শোধ হবে- এটা ভেবে শেষ পর্যন্ত মত দেয় মধু। তবে শর্ত জুড়ে দেয়, পড়াশুনা চালিয়ে যাবে সে।

এসব মেনে নেয়ায় সে আর না করতে পারে নি। পরিবারের সবাই চায় বিয়েটা হোক। হলো। আড়াই মাসের মাথায় এসএসসির ফলাফল প্রকাশ হলো। প্রথম বিভাগে পাস করেছে। এবার সে এইচএসসি পড়তে চায়।

কিন্তু হৃদয় ভালো করেই জানে, এটা কোনভাবেই মেনে নেবে না হৃদয়ের বাবা ও মা। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে মধুকে বাড়ি থেকে আউট করার একটা পরিকল্পনা আবারো করলো সে।  

ভর্তি নিয়ে অটোমেটিকেলি শাশুড়ি আর শ্বশুরের সাথে কিছুটা বাক বিতণ্ডা হলো মধুর। শ্বশুর তো বলেই বসলো—
- মোর ব্যাটা জজ-ব্যারিস্টার নোহায়, যে বউ অ জজ-ব্যারিস্টার বানেবার নাইকবে। তাছাড়া তোর বাপ কত টাকা দিছে যে, তোক মুই পড়াইম?

এটা শুনে চুপ থাকেনি মধুও। সেও উত্তর দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, মধু রুমে যেয়ে শুধুই কাঁদছে।

এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি হৃদয়। সেও রুমের মধ্যে গিয়েই মধুকে বললো,
-তোর উচিত হয় নাই, আব্বার মুখের ওপর কথা কওয়া।
এবার সোজা হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে, মধু শুধু একটাই কথা জানতে চাইলো, আচ্ছা আমার থাকা না থাকায় তোমার কি কিছু যায় আসে?
- না, কিছুই আসে যায় না, উত্তর দিলো হৃদয়।
- তাহলে আমাকে তোমরা বাঘের মতো বন্দি করে রেখেছো কেন? কেন বাড়ি যেতে দিচ্ছো না।

এটা শোনা মাত্রই রুম থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে হৃদয় তার বাবা আর মা কে বলল,
-আব্বা, হামরা নাকি অক বাঘের মতো বন্দি করি থুইছি, অক নাকি বাপের বাড়ি যাবার দ্যাওছি না।
এটা শুনে এবার হৃদয়ের আব্বা বলে উঠলেন— কয় কি রে? এ্যা, কয় কি? জমিদারের বেটি নাকি। যা, একটা ভ্যান ডাকি আনতো। আনি অর সব জিনিস দিয়ে বাপের বাড়িত থুইয়া আয়। সারাজীবনের জন্য বাপের বাড়িতেই থাওক। আর জজ-ব্যারিস্টারি পড়ুক।

এটা শোনামাত্রই বাড়ির বাইরে গিয়ে একাধিক ভ্যান ডেকে এনে বাড়িতে এসে দেখলো, তার বাবা মধুর বিয়েতে পাওয়া সব জিনিসপত্র বাইরে ফেলে রেখেছেন। এসব নিজ হাতে ভ্যানে তুলে দিলো হৃদয়। বেঁধে দিলো শক্ত করে। মধুও ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ভ্যানে গিয়ে বসলো।

ভ্যান মধুকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসেছে। পেছনে পেছনে এসেছে হৃদয়ও। শেষবারের মতো মধুর সাথে কথা বলতে চায় সে। হাতের ইশারায় মধুকে কাছে ডাকছে। মধু জানে, এটা লোক দেখানো ডাক। তবুও নামে, কাছে যায়, শুনতে চায় হৃদয়ের শেষ কথা।   জানতে চায় কেন হৃদয় তার সাথে এমন করলো?
কাছে গিয়ে বলল, বলো?
- কিছু না, চলো বাড়ি ফিরে যাই, আব্বার কাছে ক্ষমা চাও।
- সে কথা এতদূর নিয়ে এসে বলতে হচ্ছে কেন? এমন মানুষ হাসানোর মানে কি? কেন আমার জীবনটাকে নিয়ে খেললে তুমি? সত্যিকার কারণটা কি বলবা?

এবার নিষ্ঠুরের মতো অট্টহাসি হেসে উঠে হৃদয়।   হাতের সিগারেট ঠোঁটে লাগায়। একটা টান মারে। আর গোল গোল করে আকাশের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়ে।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মধু।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ