ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

বড়গল্প/পর্ব-৪

কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-৪)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-৪) বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ইতিপূর্বে কানে তালা লাগিয়ে রেকর্ড-প্লেয়ারটা হঠাৎ বিকট একটা শব্দ করে থেমে গেল। নিখিলেশ কেঁপে ওঠে। ভেরি ইন্টারেস্টিং! হোয়াটস্ রং উইথ হার? কিন্তু মহুয়া অমন হাঁ করে চেয়ে আছে কেন? ও’কি আমায় চিনতে পারছে না!

ইতিপূর্বে কানে তালা লাগিয়ে রেকর্ড-প্লেয়ারটা হঠাৎ বিকট একটা শব্দ করে থেমে গেল। নিখিলেশ কেঁপে ওঠে।

ভেরি ইন্টারেস্টিং! হোয়াটস্ রং উইথ হার? কিন্তু মহুয়া অমন হাঁ করে চেয়ে আছে কেন? ও’কি আমায় চিনতে পারছে না!

ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে বড্ড ইতস্তত বোধ করে নিখিলেশ। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে মুহূর্তের জন্য বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। অবলীলায় ভদ্রতার সৌজন্যে মৃদু হেসে বলল-‘এক্সকিউজ্ মি ম্যাম, মিস্ ব্যানার্জী, আই মিন....!’

তক্ষুণি ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক দিয়ে ওঠে মহুয়ার। ওর চোখেমুখেও অপার বিস্ময়। যেন অনেকক্ষণ অন্ধকারে ডুবে ছিল। এতক্ষণে কিনারা খুঁজে পেলো। নিখিলেশের কথা শেষ না হতেই একগাল মুক্তাঝরা হাসি ছড়িয়ে বলে,-‘আ-আপনি নীলুদা না, মানে নিখিলেশ বাবু না? লন্ডন থেকে কবে ফিরলেন?’

এতক্ষণ পর লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে নিখিলেশ। অস্ফূট হেসে বলল,-‘ভাগ্যিস চিনতে পেরেছেন, নইলে এক্ষুণিই দিচ্ছিলেন বিপদে ফেলে। ’

-‘কিন্তু আপনি এভাবে, বিনা নোটিশে! এতকাল পর কোথা থেকে আসছেন?’

মুখের হাসিটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল নিখিলেশের। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বলল,-‘সে কি! বৌদি কিছু বলে নি?’

-‘কই, না তো। গতকাল এতক্ষণ কথা হলো, আপনি আসছেন, সেকথা একবারও তো বলল না শুভ্রাদি!’

-‘কিন্তু আপনার কাছে নোটিশ ছাড়া আসা যাবে না, তা তো জানতাম না!’

নিখিলেশের ঠোঁটের কোণে চোরা হাসির ঝিলিকটা নজর এড়ায় না মহুয়ার। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,-‘আপনারা দেবর বৌদির মধ্যে কখন কি কথা হয়, তা আমি জানবো কী করে বলুন!’

-‘দেখলেন তো, যোগাযোগ না থাকলে এই অবস্থাই হয়!’

আশ্চর্য! ভাবতেই অবাক লাগছে মহুয়ার। কথাবার্তায় এতটুকু জড়তা নেই নিখিলেশের। যেন কতদিনের চেনা-পরিচয়, কত ঘনিষ্ঠতা। অথচ তেমনভাবে কখনো আলাপচারিতাই হয়নি ওর সাথে। মনেই হচ্ছে না নিখিলেশ একজন বিলেতফেরত ডাক্তার। চাইল্ড্ স্পেশালিস্ট। এখনও সেই স্বতঃস্ফূর্তির প্রলেপমাখা ওর চোখেমুখে।

হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে নিখিলেশ বলল,-‘দরজা থেকেই বিদায় দেবেন না কি! ভিতরে আসতে বলবেন না! এসে বোধহয় ডিস্টার্ব করলাম, তাই না!’

চকিতে থতমত খেয়ে গেল মহুয়া। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,-‘না, না, তা হবে কেন! বরং এসে ভালোই করেছেন। ভীষণ বোর ফিল করছিলাম। বাড়িতে আজ কেউ নেই। আমি একা। ’

-‘সে কি! মাসিমা-মেসোমশাই বাড়িতে নেই! কোথায় গেছেন?’ বলে থমকে দাঁড়ায় নিখিলেশ।

পিছন ফিরে মহুয়া বলল,-‘ওমা, দ্যাখো কাণ্ড! আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন, আসুন। ভিতরে আসুন!’

সলজ্জে নিখিলেশ বলল,-‘বৌদিরা পার্টিতে যাবে বলল, ভাবলাম এই অবসরে ঘুরেই আসি, তাই চলে এলাম।
আর তা’ছাড়া সম্পর্ক তো একটা আছেই। আফটার অল্ দাদার শ্যালিকা বলে কথা। ’

হেসে ফেলল মহুয়া। -‘তাই বুঝি! দেখে তো চিনতেই পারছিলেন না। অবশ্য না পারারই কথা। ’

নিখিলেশ ভাবল, সাড়ে ন’টা বাজে এখন। মহুয়া একা বাড়িতে। এত রাতে ওর সাথে আড্ডা দেওয়াটা মোটেই শোভনীয় নয়। শুনলে মাসিমা-মেসোমশাই নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন, নিন্দে করবেন। তারচে’ বরং ফিরে যাওয়াই বেটার। কিন্তু যাই বললে কি আর যাওয়া যায়! পড়েছে মহুয়ার পাল্লায়, রেহাই নেই। সহজে ছাড়বার পাত্রী  নয়।
হলোও  ঠিক তাই। ভ্রু-যুগল উত্তোলন করে মহুয়া বলল,-‘ও কি, আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন? এতো কি ভাবছেন বলুন তো? ভিতরে ঢুকতে ভয় হচ্ছে বুঝি!’
ফিক্ করে হেসে বলল,-‘মশাই, এখানে বাঘ ভাল্লুক নেই যে আপনাকে খেয়ে ফেলবে। আপনি না একজন পুরুষ মানুষ। এতো ভয় কিসের? আরে আসুন আসুন, ভিতরে আসুন। ’

মৃদু হাসল নিখিলেশ। -‘কী যে বলেন না, তা হবে কেন! এক্চুয়েলি, লং জানিং করে এসেছি তো! টায়ার্ড ফিল করছি। দেখা তো হয়েই গেল! তাই বলছিলাম, আজ যাই মিস্ ব্যানার্জী। আরেকদিন আসবো। ’

মুখখানা ব্যাঁকা করে মহুয়া বলল,-‘হুম, যাই বললেই হলো! ঘরের দুয়োরে এসে ফিরে যাবেন, তা হবে না। ’

ঝট্ করে নিখিলেশের হাত থেকে অ্যাটাচিটা টেনে নিয়ে বলে,-‘জায়াগার অভাব? এখানেও রেস্ট নেওয়া যাবে। মামণি বাড়ি থাকলে এতক্ষণে গল্প করতে বসে যেতেন। জিজ্ঞ্যেস করতেন, ইংল্যান্ড দেশটা কেমন! ওখানকার মানুষজন কেমন! খাবার দাবার কেমন! আপনি এসে ফিরে গেছেন শুনলে ভীষণ রাগ করবেন। শুভ্রাদিকে এক্ষুণিই ফোন করে মেসেজ রেখে দিচ্ছি, আপনার ফিরতে দেরি হবে। ’
কিছুক্ষণ থেমে বলে,-‘বাব্বা, সন্ধ্যে থেকে কী ঝড়-বৃষ্টিই না বয়ে গেল। ভাবলাম, আজ আকাশটাই বুঝি ফুটো হয়ে গেল। যাক, ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন। বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এবার গরমাগরম একটু চা হলে কেমন হয় বলুন তো! সাথে মুখরোচক কিছু....! ওয়েট এ মিনিট। আমি এক্ষুণি আসছি। বলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল অন্দর মহলের দিকে। ’

মনে মনে ভীষণ রাগ হলো নিখিলেশের। কিছু বলবার সুযোগই পেলো না। এসেছিল বাহানা করে মহুয়ার সাথে দেখা করতে। কিন্তু বাড়িতে যে কেউ থাকবে না, তা কে জানতো! অগত্যা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহুয়াকে অনুসরণ করে নিখিলেশও অন্দর মহলের দিকে এগিয়ে গেল।
                                                                                         
তিন.
পরিষ্কার আকাশ। অন্ধকার রাত। গ্রহ নক্ষত্রগুলি সব ঝলমল করছে। একটুও মেঘ নেই কোথাও। মনেই হচ্ছে না সন্ধ্যে থেকে ঝড়-বৃষ্টি বয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের মধ্য আকাশের গায়ে উদ্ভাসিত চাঁদের আলোতে ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। রাস্তার যানবাহনগুলি সব যথারীতি চলাচল করছে, শোনা যাচ্ছে। মন-মানসিকতাও খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে মহুয়ার। ভিতরে ভিতরে মন-প্রাণ অস্ফূট খুশীতে ভরে ওঠে। রেকর্ড-প্লেয়ারটা অন্ করে নিখিলেশের অ্যাটাচিটা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত মনে দোলাতে দোলাতে গিয়ে ঢোকে কিচেনরুমে। ততক্ষণে কানে তালা লাগিয়ে তীব্র আওয়াজে মধুর ঝংকারে ভেসে আসে রবীন্দ্রসঙ্গীত:
আমার এ পথ / তোমার পথের থেকে অনেক দূরে / গেছে বেঁকে গেছে বেঁকে / আমার এ পথ।

থমকে দাঁড়ায় নিখিলেশ। মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে একগাল হেসে বলল,-‘বাহ, চমৎকার! রবি ঠাকুরের প্রতিটি গানই মনকে ছুঁয়ে যায়। ’
বলে সুরে সুর মিলিয়ে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে। শুনতে পেয়ে কিচেনরুম থেকে মহুয়া বলল,-‘বা, আপনি সঙ্গীতচর্চাও করেন বুঝি!’

কথাট ঠিক নিখিলেশের কানে পৌঁছালো না। টি-টেবিলে একটা সিনে ম্যাগাজিন পড়েছিল। সেটা হাতে নিয়ে উল্টাতেই মহুয়া এসে বলে,-‘কিছু বললেন?’

-‘বলছিলাম, রবি ঠাকুরের প্রতিটি গান হৃদয়কে স্পর্শ করে। গানটি শুনে আজ মনে হচ্ছে, সত্যিই অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। ভাবছি, এবার এখানেই থেকে যাবো!’

 সবিস্ময়ে মহুয়া বলল,-‘এ্যাঁ, এখানে মানে!’

-‘ভারতবর্ষে!’ দৃঢ় জবাব নিখিলেশের। মহুয়ার দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টি হেনে বলে,-‘আপনি কি ভেবেছিলেন?’

-‘না, না, আমি বলছিলাম, আপনি কোলকাতায় ডাক্তারি করবেন। ভালোই তো। চাইল্ড স্পেশালিস্ট বলে কথা। নিউ প্যারেন্টদের জন্যে এটা একটা গুড নিউজ। কি বলেন, তাই না!’

-‘হ্যাঁ, এই-ই তো! আর কি!’

বাঁকা চোখে তাকায় মহুয়া। প্রতিবাদের সুরে বলে,-‘বারে, আর কিছুই নয়?’

ফিক্ করে হেসে ফেলল নিখিলেশ। হাসিটা বজায় রেখে বলল,-‘আর কি? আপনিই বলুন!’

-‘কেন, প্রতিদিন শুভ্রাদির হাতের মজার মজার শোয়াদিষ্ঠ রান্না খাবেন। সেটা কিছু না!’  
 
-‘সেটা তো কম্পালসারি বলতে হয়। দেবর বলে কথা। এতো বছর পর এলাম, ভালো মন্দ একটু খাওয়াতেই পারে!’
হঠাৎ খপ্ করে নিখিলেশের হাত ধরে ওকে সোফায় বসিয়ে দেয় মহুয়া। ভ্রু-যুগল উত্তোলন করে অভিভাবকের মতো আদেশ দিয়ে বলে,-‘এবার একটু রিল্যাক্সড হয়ে বসুন দেখি! গান শুনুন। চায়ের জলটা ফুটতে ফুটতে এতক্ষণ শুকিয়ে গেল বোধহয়। আমি এক্ষুণি চা-জলখাবার নিয়ে আসছি। ’ বলে দ্রুত ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল।  

ড্রইং-রুমের বাইরে চারিধারে আয়না বাঁধানো। নিজের চেহারা আয়নায় নজরে পড়তেই আঁতকে ওঠে মহুয়া,-‘ও গড্, কি ওড লাগছে দেখতে। চোখমুখ, সর্বাঙ্গ এলোমেলো যে! ইস্, কি ভাবছে কে জানে নিলুদা। নিশ্চয়ই শুভ্রাদিকে গিয়ে সব বলবে। দূর, বললে বলুক গে। আমার খবর কে রাখে!’
বিড়বিড় করতে করতে পড়নের কাপড়টা ঠিকঠাক করে পরে গিয়ে ঢোকে কিচেনরুমে। ঢুকেই মনে পড়ে,-ও শিট, খাবারগুলি তো সব ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। নিখিলেশকে কি দেবে এখন!

বড্ড আফশোস হয় মহুয়ার। এতোগুলি খাবার। কেন যে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো, থাকলে নিখিলেশকে দিতে পারতো। মজা করে খেতো। কে জানতো, হুট্ করে নিখিলেশ আজই এসে হাজির হবে। স্বপ্নেও তো ভাবতে পারেনি।

দেওয়ালে টাঙ্গানো বড় বড় ঋষি-মুণিদের ছবিগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছিল নিখিলেশ। কখন যে মহুয়া এসে ঘরে ঢুকেছে টের পায়নি। সঙ্গে নিয়ে এসেছে লেবুর শরবত আর কিছু মুখরোচক খাবার। হঠাৎ চুড়ির ঠুনঠুন শব্দে চমকে ওঠে নিখিলেশ।
মহুয়া বলল,-‘ছবিগুলি খুব রিসেন্ট বাঁধানো হয়েছে। হরিদ্বার থেকে আনা। ধরুন, গলাটা একটু ভিজিয়ে নিন। গরম গরম চা নিয়ে আসছি। ’ বলতে বলতে শরবতের গ্লাসটা তুলে দেয় নিখিলেশের হাতে। নিখিলেশ তক্ষুণি এক চুমুকে ঢক্ ঢক্ করে পান করেই বুকের মাঝখানে হাত বুলায়। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,-‘আহ্, এতক্ষণে প্রাণটা জুড়োলো। কি তেষ্টাই না পেয়েছিল!’

-‘এ্যাঁ, আপনার তেষ্টা পেয়েছিল, তা এতক্ষণ বলেন নি কেন?’ খুব উৎকন্ঠিত হয়ে বলল মহুয়া।

গ্লাসের গায়ে আঙ্গুলে টোকা দিতে দিতে নিখিলেশ বলল,-‘কখন বলবো বলুন! সে সময় আর দিলেন কোথায়! যা নাটক দেখালেন!’

ফোঁস করে ওঠে মহুয়া। ভ্রু-যুগল কুঁচকিয়ে বলে,-‘কি, এতক্ষণ আমি নাটক দেখাচ্ছিলাম? আমায় নটঙ্কির মতো লাগছে? বলা নেই, কওয়া নেই, হুট্ করে এসে পড়েছেন। একবার ভেবে দেখুন তো, আমার অবস্থায় পড়লে আপনি কি করতেন? কীই বা আর করতেন, হতেন যদি মহিলা, তবেই বুঝতে পারতেন। ’

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে নিখিলেশ বলল,-‘বাব্বা, চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। আমায় অবাক করে দিলেন। ’

-‘কেন, এতে অবাক হবার কি আছে! আমি কি জানতাম, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আপনি এসে পড়বেন। আর তা’ছাড়া...!

কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল মহুয়া। ওর চোখেমুখের হাবভাব দেখে ঠোঁটের কোণে কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে নিখিলেশের। গম্ভীর হয়ে গেল মহুয়া। ম্লান হেসে বলল,-‘উপহাস করছেন তাই না! করবেনই তো! নিয়ত যখন খারাপ হয়, তখন পিঁপড়েও খোঁচা মারে। আই মিন, দুর্বলকেই বেশি কষ্ট দেয় মানুষ। রঙ্গ ব্যঙ্গ করে। তামাশা করে। এতে মজা পায় সবাই।

মহুয়ার এধরনের অসন্তোষমূলক কথাবার্তায় মুখখানা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল নিখিলেশের। নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। গিল্টি ফিল করে। চকিতে একটা বিষণ্ন হাসি ফুটিয়ে বলে,-‘না না মিস্ ব্যানার্জী, তা নয়। এতো সিরিয়াসভাবে নিচ্ছেন কেন?  আপনি খামাখা ভুল বুঝছেন। আই শকড! আই এ্যাম্ জাস্ট জোকিং। এই সামান্য ব্যাপরে আপনি এতো চটে যাবেন, আমি তো ভাবতেই পারিনি!’

মনে মনে অসন্তুষ্ট হয় মহুয়া। আলমিরার ড্রয়ারটা খুলে কিছু খোঁজার ভান করে বলে,-‘এটা কিন্তু মোটেই ভালো নয় নিখিলেশ বাবু। এ ধরনের জোক আমি একদম পছন্দ করি না।

-‘যাব্ বাবা, দিলেন তো ফ্যাসাদে ফেলে। বৌদি তা’হলে ঠিকই বলেছিল। ’

চোখ পাকিয়ে তাকায় মহুয়া। গম্ভীর হয়ে বলল,-‘কি-কি বলেছে শুভ্রাদি?’

আমতা আমতা করে নিখিলেশ বলল,-‘আপনি যা ভাবছেন, সেরকম মারাত্মক কিছু নয়। বৌদি একদিন কথায় কথায় বলছিল যে, ফাঁদে পড়লে আর রক্ষে নেই!’

চটে যায় মহুয়া। চোখমুখ ফুলিয়ে অসন্তোষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ খই ফোটার মতো ঠোঁটের ডগা দিয়ে ওর বুলি ছুটতে থাকে। -‘রক্ষে নেই মানে! কার রক্ষে নেই? আমার না আপনার? থাকুন না ক’টা দিন, শুভ্রাদি নিজেই টের পাবে। ওর বিয়ের পরই তো আপনি দেশান্তর হলেন, ওই বা আর জানবে কি করে!’

নিখিলেশ নিরুত্তর। মহুয়ার আপদমস্তক নজর বুলিয়ে মনে মনে বলে,-কি সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা। এ যে একেবারে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়বে দেখছি। কিন্তু সে অপেক্ষা আর রাখে না। ইতিপূর্বে মহুয়ার জেরায় পড়ে যায়।

-‘কি, কিছু বলছেন না যে! এবার উত্তর দিন। ’

ফিক্ করে হেসে ফেলল নিখিলেশ। প্লেট থেকে ক’টা কাজুবাদাম নিয়ে টপাটপ মুখে পুরতে পুরতে বলল,-‘ও.কে মিস ব্যানার্জী, আজ উঠি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। ’

নিঃশব্দে হেসে ফেলল মহুয়া। বলল,-‘রাগ করেছেন!’
 
ততক্ষণে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিখিলেশ। মহুয়া বলল,-‘এ কি, আপনি সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছেন?’

নমস্কার জানিয়ে নিখিলেশ বলল,-‘না মিস্ ব্যানার্জী, আজ চলি। আরেক দিন আসবো!’ বলে অ্যাটাচিটা হাতে তুলে নেয়।
মহুয়া তৎক্ষণাৎ দ্রুত এগিয়ে আসে। অ্যাটাচিটা নিখিলেশের হাত থেকে টেনে নিয়ে বলে,-‘আচ্ছা, আপনি কি শুরু করেছেন বলুন তো! সেই তখন থেকে খালি মিস্ ব্যানার্জী, মিস্ ব্যানার্জী করছেন। আমার নাম নেই বুঝি। কোনো কথা শুনছি না। এতকাল পর এসেছেন, না খেয়ে কিছুতেই যেতে দিচ্ছি না! আবার কবে আসবেন তার ঠিক আছে! আজ কোনো কথা শুনবো না। খেয়ে যেতেই হবে, ব্যস!’

মাথা নেড়ে নিখিলেশ বলল,-‘বেশ, তাই-ই হবে। কিন্তু একটা শর্তে, সারাক্ষণ ঐ নিখিলেশ বাবু, নিখিলেশ বাবু করা চলবে না। আমায় নিখিলেশ বলেই ডাকবেন। ’

সলজ্জে হাসল মহুয়া। বলল,-‘বারে, তা বলে আপনাকে নাম ধরে ডাকবো না কি? আপনি হাসছেন কেন? চালাকি হচ্ছে না! ওসব শুনছি না। বলে দ্রুত পায়ে দরজার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়।

বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় নিখিলেশ। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মহুয়ার মুখের দিকে। মনে মনে বলে,-আশ্চর্য, এতো অল্প সময়ে এতখানি আন্তরিকতা! এতো ঘনিষ্ঠতা! ভাবাই যায় না। অথচ মনের অগোচরে কখন যে বন্ধুত্ব হলো, কখন হৃদ্যতা গড়ে উঠলো, নিখিলেশ নিজেও টের পেলো না। কিন্তু আজ বেকায়দায় মহুয়ার পাল্লায় পড়ে গিয়েছে। ও’ একেবারে নাছোড়বান্দা। না খাইয়ে যেতে দেবে না। ওর অ্যাটিচুড দেখে নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, বড্ড জেদী, একরোখা মেয়ে। এখনও ছেলেমানুষিই যায়নি। একটুতেই চটে যায়।
ভাবতে ভাবতে নিখিলেশ আবার বসে পড়ে সোফায়। মনে মনে হাসলও। খানিকটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো,-‘বেশ, তা নয় মানলাম, কিন্তু ম্যাডাম্ আমাকে খাওয়াবেন কি শুনি!’

-‘কেন? যা খেতে চাইবেন। আপনি যা খেতে ভালোবাসেন!’

-‘আর ইউ সিওর?’

মাথা নেড়ে মহুয়া বলল,-‘ইয়েস স্যার! একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর! আই অ্যাম নট জোকিং লাইক ইউ!’

-‘তা’হলে তো খেয়ে যেতেই হয়। আগে জানলে প্রিপেয়ার্ড হয়ে আসতাম!’

-‘প্রিপেয়ার্ড হয়ে আসতাম মানে! ফর হোয়াট?’

-মানে, আপনার এখানেই থেকে যাবার ব্যবস্থা করতাম!

অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে মহুয়া। গলার স্বর খানিকটা বিকৃত করে বলে,-‘ঠাট্টা হচ্ছে! মশাই, এখানে নয়, রেস্টুরেন্টে। আপনাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো। আমি তো জানতাম না আপনি আসবেন। জানলে নিশ্চয়ই রান্নাবান্না করে রাখতাম। আপনি বসুন, আমি এক্ষুণিই রেডি হয়ে আসছি। ’

অগত্যা, করণীয় কিছু নেই। বাধ্যতামূলক নিখিলেশকে মেনে নিতেই হলো। মহুয়ার মন রক্ষার্থে বলল,-‘ওকে ম্যাডাম্, হারি আপ। ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে দেখি, একটা ক্যাব পাওয়া যায় কি না। ’

চলবে

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
জেএম/এমজেএফ


** কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-১)
** কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-২)
** কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-৩)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ