মেট্রোর ভূতল থেকে বেরিয়ে আমি ও ম্যানুয়েল সামান্য হেঁটে চলে আসি সাঁজেলিজে বলে প্যারিস নগরীর সারি সারি বৃক্ষের সবুজ শোভায় পল্লবিত সরনিতে। ম্যানুয়েলের সঙ্গে আজকাল আমার অন্তরঙ্গতা বাড়ছে।
দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই। বাস্তিল দিবস। দিনটি ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৮৯ সালের এই দিনে প্যারিসের আমজনতা আক্রমণ করে বাস্তিল দূর্গ। এ কেল্লায় রাজা চতুর্দশ লুই এর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যারা লেখাজোখা করেছিলেন, এসব প্রতিবাদী মানুষদের বিনা বিচারে আটক রাখার প্রথা ছিলো। বিদ্রোহী জনতা দূর্গে ঢুকে পড়ে তাবৎ কিছু তছনছ করে। মুক্ত হন রাজবন্দিরা। জনতার দখলে আসে গোলা-বারুদ ও গাদা বন্দুক। প্যারিসের সর্বত্র শুরু হয় ফরাসি বিপ্লব। ঘোষিত হয় মানবাধিকার সংক্রান্ত বিখ্যাত ইশতেহার।
বাস্তিল দিবসের স্মৃতিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সামরিক কুচকাওয়াজ। তাই সাঁজেলিজের প্রশস্ত সরনিতে জড়ো হয়েছেন প্যারিসের নাগরিক সমাজ। যে বৃক্ষশোভন ফুটপাথ ধরে আমি ও আমার সুহৃদ ম্যানুয়েল হাঁটছি, তার পাশের সুপ্রশস্ত এভিনিউ জুড়ে অগ্রসর হচ্ছে অশ্বারোহী সৈনিকদের জমকালো একটি দল। তাদের কুচকাওয়াজ উপভোগ করতে করতে আমরা হেঁটে আসি একটি সুর্দশন ইমারতের সামনে। সরনিতে আজ গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাজপথে ক্যাজুয়েল পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছু মানুষ। তাদের কেউ কেউ এসেছেন বাইসিকেল চড়ে। সকলে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন দূরে। আমরা হেঁটে যেতে যেতে দেখি শর্টস্ পরা এক মাঝ-বয়সী পুরুষ স্কুটারে বসে হাই তুলছেন। চোখাচুখি হতেই তিনি মৃদু হেসে সম্ভাষণ করেন। তার সঙ্গে কথাবার্তা হয় টুকটাক। জানতে পারি,যুদ্ধবিমানের মহড়া শুরু হতে যাচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে। তো আমরা আগ বাড়ি বিজয় তোরণের দিকে। আমাদের পাশে সমান্তরালভাবে চলছে দুটি বেজায় বড়, তবে এ মুহূর্তে জনবিরল রাজপথ। তাতে আদুল গতরেÑমুখে রঙিন খড়ি দিয়ে মুখোশের মতো চিত্র আঁকা নওজোয়ানরা নানা কিসিমের বর্শা ও আদিম সমরাস্ত্র নিয়ে শরীরের ম্যাসল মুচড়িয়ে দেখাচ্ছে বিবিধ রকমের কেরদানি। ম্যানুয়েল মৃদুস্বরে বলেÑ আজব কিসিমের এ আদিবাসী মাওরি গোত্রের মানুষেরা এসেছে নিউজিল্যান্ড থেকে। কুচকুচে কালো কোনো পশুর লোমে তৈরি লেবাসপরা এক মাওরি যোদ্ধা গদা হাতে দর্শকদের তাড়া করার ভঙ্গি করলে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকরা হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করে।
বিজয় তোরণের সামনের চত্বর স্টিলের ফেন্স দিয়ে ঘেরা। ওখানে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা পরস্পরের ছবি তুলছে। গ্র্যান্ডমাদের সাথে বাচ্চারাও এসেছে আজকের অনুষ্ঠান দেখতে। তাদের হাতে ফরাসি পতাকা। গ্রিক নারী আগাথার এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। ম্যানুয়েল চারদিকে তাকাতাকি করে তাকে কোথাও স্পট করতে পারে না। সে আগাথাকে টেক্সট্ পাঠায়। বুঝতে পারিÑ আজকের অভিসারে তার কাঙ্ক্ষিত নারীটি এখনো অকুস্থলে এসে পৌঁছেনি। আমরা সময় কাটানোর অসিলায় সাঁজেলিজের সরনিতে হাঁটাচলা করি। ম্যানুয়েল এ কুচকাওয়াজ সম্পর্কে বেশ খানিকটা ওয়াকিবহাল। আমি চাঁদতারা আঁকা ঝাণ্ডা হাতে ধবধবে সাদা হ্যাট-কোট পরা তিনজন চৌকশ সৈনিকের পেছন পেছন মার্চ করে আসা সামরিক ট্রুপের দিকে দারুণ কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছি দেখে সে বলে ,‘মাই ডিয়ার বাডি, বাস্তিল ডে ইজ আ বিগ টাইম ফেস্টিভ্যাল ইন প্যারিস। আজকের শোভাযাত্রায় শরিক হয়েছে পৃথিবীর তেহাত্তরটি দেশ থেকে আগত সামরিক বাহিনীর বাছা বাছা সদস্যরা। তুমি যাদের দিকে হাঁ- করে তাকিয়ে আছো তারা এসেছে আলজেরিয়া থেকে। ’
‘থ্যাংক ইউ সো মাচ বাডি,’ বলে ম্যানুয়েলের পিট চাপড়িয়ে দিয়ে আমি আবার খেয়াল করে দেখতে শুরু করি মহড়া দেখতে আসা হরেক কিসিমের মানুষজনকে। আমাদের সামনে বেবি-বাগি ঠেলে ঠেলে হাঁটছে এক শক্তসমর্থ পুরুষ। ম্যানুয়েল মৃদুস্বরে বলে ,‘লুক অ্যাট দিস গাই কেয়ারফুলি। ডু ইউ সি হোয়াট ইজ রঙ উইথ হিম?’
আমি নিরিখ করে তাকে দেখি। মানুষটি বেবি-বাগির ফ্রেমে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ভিড়ে নজর ফেলে কী যেন খোঁজে। তারপর গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে তা সাবধানে ফোকাস করে। ঠিক বুঝতে পারি না তার আচরণে অ্যাবনরমালিটি কোথায়? ম্যানুয়েল একটু অধৈর্য হয়ে বলে ,‘ ইউ রিয়েলি নিড টু লুক অ্যাট কেয়ারফুলি, দৃষ্টিকে একটু ক্রিটিক্যাল করো বাডি, ইউ উইল সি মাচ মোর। ’
এ ধরনের লেকচার আমার পছন্দ হয় না। তাই বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালে সে ফিসফিসিয়ে বলে ,‘মনযোগ দিয়ে তার বেবি-বাগিটি দেখো মাই ডিয়ার বাডি,ওখানে কোনো শিশু নেই। পুতুল,ঝুমঝুমি, দুধদানি, বিভ সবই আছে কিন্তু! এসব দিয়ে ইমপ্রেশন দেয়া হচ্ছে, এ বেবি-বাগিতে আসলেই শুয়ে আছে একটি শিশু। যাতে বাচ্চার চোখেমুখে রোদ না লাগে এ জন্য তার উপরের শেডটিও নামানো। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আজকের মহড়ার মতো সফ্ট টার্গেট হয়তো টেরোরিস্টরা ব্যবহার করতে চাইবে। তাই ফ্রেন্স সিক্রেট সার্ভিস এখানে নজরদারির জন্য নিয়োগ করেছে সাদা পোষাকে অজস্র্র এজেন্ট। দিস বেবি-বাগিওয়ালা ইজ ওয়ান অব দেম। তার বাগির ফ্রেম থেকে ঝুলছে যে কয়টি খেলনা, এগুলো আসলে সার্ভিলিয়েন্স টুলস্। তাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলা হয়ে যাচ্ছে। ’ বেবি-বাগিওয়ালা আমাকে খেয়াল করে দেখতে শুরু করলে আমরা দ্রুত হেঁটে তাকে অতিক্রম করে চলে আসি বৃক্ষছায়ায় সিগ্ধ সড়কদ্বীপের কাছে।
ম্যানুয়েল তার লেকচারকে কনটিনিউ করে বলে ,‘মাই ডিয়ার বাডি, প্লিজ লিসেন ওয়ান থিং ...প্যারিসের নারীরাও তাদের সফ্ট ফেব্রিকে তৈরি স্বল্প ঝুলের পোশাক,আকর্ষণীয় অনাবৃতি, সৌরভ ও মেকাপে তাদের শরীরের চারদিক ছড়িয়ে রাখে বেবী-বাগির সেট-আপের মতো কৃত্রিম আবহ। তুমি যখন তাদের দিকে তাকাবেÑ উদ্দিষ্ট নারীর চলাচলের দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গি, কিঞ্চিত পাউটি ঠোঁট বা পারফিউমের ছটায় প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে পড়বে না, ডোন্ট বি স্পেলবাউন্ড উইথ দেয়ার লুকস্, চার্মস্ অ্যান্ড অল দ্যাট। ইউ রিয়েলি হ্যাভ টু অবজারভ্ দেম ক্রিটিক্যালি, সাদা পোশাকের সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টরা যে রকম নজর করেÑ ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কার ধুপদুরস্ত স্যুটের ভেতর লুকানো আছে এক্সপ্লোসিভ; ঠিক সেরকম ভাবে তোমাকেও বুঝে নিতে হবে এ নারী বাস্তব সংসারে কতোটা অতৃপ্ত, দ্যাটস্ দ্যা ম্যাজিক কি টু ওপেন হার সিক্রেট ওয়ার্ল্ড। ’
আমি ম্যানুয়েলের লেকচারে বিরক্ত হলেও তাকে ইটেনশনালি তোয়াজ করে চলি। মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট আগে আমি তার যৌন-স্বভাব নিয়ে মন্তব্য করে বিরাগভাজন হয়েছি। আমি অবগত যে, তার মাঝে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠার অমিত শক্তি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। আপাতত তাকে ঝাঁপিতে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকা গোখরা সাপের মতো শান্ত দেখালেও তার ছোবল মারার শক্তিকে আমি সমীহ করি। তাই তাকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য হিসাব-নিকাস করে পরবর্তী চাল নির্বাচন করি।
ম্যানুয়েল কী যেন ভেবে জানতে চায়,‘তুমি আরো দু’এক জন সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টকে খুঁজে বের করতে চাও কি বাডি?’
আমি জবাব দিই ,‘ইয়েস, অফকোর্স, তবে ভুলে যাওয়ার আগে অত্যন্ত ফ্র্যাংকলি একটি মন্তব্য করতে চাই। ম্যানুয়েল, অই যে ম্যাজিক কি’র বিষয়টা তুমি ব্যাখ্যা করলে, আ হিউজ থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট, তোমার যাদুময় চাবি খুঁজে বের করার দক্ষতাকে আমি সত্যিই এডমায়ার করি। ’ আমার তোয়াজে কাজ হয়, সে আন্তরিকভাবে হেসে জবাব দেয়,‘ডোন্ট ম্যানসন ইট ম্যান। আজকে আরেকটু সময় আমার সাথে কাটাও, খেয়াল করে দেখো কীভাবে আমি আগাথার কাছাকাছি হই, আই লাইক টু ব্রেক দ্য আইস অব হার স্ট্রেস ফার্স্ট, তারপর বালুচরে যে রকম ঢেউ ভেঙ্গে পড়ে, সে রকম সেও আছড়ে পড়বে আমার পাঁজরে..ইউ উইল উইটনেস দিস ইন ইয়োর অউন আইজ বাডি। ’
প্রতিক্রিয়ায় আমি বলি,‘আগাথাকে চাক্ষুষ করার জন্য আমিও রেস্টলেস হয়ে আছি। ইজ দ্যাট ও-কে টু টক উইথ হার আ লিটিল বিট। ’ সে উদার হেসে বলে, ‘লেট মি মেক দিস পয়েন্ট ক্রিস্টাল ক্লিয়ার, আমি তাকে সার্ভিস দিচ্ছি, আমার সময় সে ক্রয় করেছে, বাট শি ইজ নট মাইন, তার ওপর আমার কোন অউনারশিপ নেই। ইন আ ওয়ে শি ইজ আ ফেয়ার গেম। গো এহেড অ্যান্ড ফ্লার্ট উইথ হার আ বিট, আই ডোন্ট মাইন্ড। ’ আমি ধন্যবাদ জানিয়ে হাই ফাইভ এর ভঙ্গিতে তার করতলে আমার করতল বাজিয়ে বলি,‘বাট হোয়ার ইজ আগাথা?’ ‘শি উইল বি হিয়ার সুন। হয়তো মেট্রোর আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন চড়ছে, তাই সিগনালের অভাবে টেক্সট্ করতে পারছে না। ’বলে ম্যানুয়েল তার আইফোন বের করে স্ক্রিনে চলমান নারীদেহের ছবি স্ক্রল করতে করতে জানতে চায়,‘ বাডি, তুমি তার কিছু ইরোটিক ছবি দেখে ওয়ার্ম আপ হতে চাও কি?’ আমি হাত নাড়িয়ে প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়ে বলি,‘আই প্রেফার টু ওয়েট, আমার আগ্রহ বাস্তবে তাকে চাক্ষুস করা। কথাবার্তা বলে দেখতে চাই গ্রিক নারীটি কতোটা সংবেদনশীল। ’ ম্যানুয়েল কাঁধ শ্রাগ করে জবাব দেয়,‘ অল রাইট দেন,চলো ডিটেক্ট করি আরেকটি সিক্রেট সার্ভিসের আন্ডার কাভার ওয়াচারকে। এতে কিছুটা সময় কিল করা যাবে। ’
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৭
জেএম