ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

ডন-বেসিনের গর্ত | ফারাহ্ সাঈদ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৮
ডন-বেসিনের গর্ত | ফারাহ্ সাঈদ ...

ভাবছি রেস্টুরেন্টের কাজটা ছেড়ে দেব। ভয় হয় আমার। যদিও একা নই আমি। ঐ শিফটে আমরা এখন দুজন। মিখায়েল আর আমি। লোকের উচ্ছিষ্ট খাবারের প্লেটগুলোকে ফর্সা করার কাজ আমাদের। চারখানা হাত নোংরা পানিতে ডুবিয়ে আমরা নাচি আর ভাবি এইতো জীবন।

মিখায়েল শুধু হাসে, কথা বলে না। চামচের গোসল সে উপভোগ করে।

তোয়ালে দিয়ে নরম হাতে গা মুছিয়ে দেয়। সাজায় চামচ-সংসার। বাবা চামচ, মা চামচ, শিশু চামচ। মাঝে মাঝে খালাতো, মামাতো চামচও। মাঝে মধ্যে দাঁত খিলানও করে। তারপর প্লেটগুলোকে আবার ফর্সা করার কাজে ফিরে যায় সে। রাত দুটোর পর অন্য এক মানুষ মিখায়েল মালেকিয়ান। সে হাসে অবিরাম। প্লেট-পিরিচকে বৃষ্টি আর টিনের চালের শব্দখেল শিখিয়ে ও নীরবে হাসে। আমি ভাবলেশহীন। ওর ঐ হাসি আমার নোংরা লাগে। এঁটোর চেও বেশি। মাঝে মাঝে মনে হয় মুখ চেপে ধরি। হাসিটা থামিয়ে দিই।

আমার যে কিসে ভয়! ভাবছি। বিশাল ডাস্টবিন, গেটের তারকাঁটা, নাকি মালিকের সোনালি দাঁত! না এসব কিছু নয়। বেসিনের গর্ত! হ্যাঁ ওটাই। প্রায় মনে হয় বেসিনটা হলদে গ্লাভ্স দুটো গিলে খাবে একদিন। একটা একটা করে। সেই সাথে আমার হাতজোড়াও। আমাকেও কী! রেস্টুরেন্টে লোক হালকা হতে শুরু করে বারোটার পর। ওয়েটার, শেফের একে একে চলে যাওয়া দেখি। চেয়ারে চেয়ারে পারফিউম আর মদের গন্ধ লেগে থাকে। সিগারেটেরও। তাদের ফেলে যাওয়া আলাপচারিতায় করিডোরের বাতাস তখনও ভারী। করিডোরের ধোঁয়াটে গন্ধটা শুকি। ওটা ভাল লাগে আমার। মনে হয় তখনও ভন ভন শব্দ হয় কোথায়। এখানে কী কেবল দুঃখী মানুষেরাই খেতে আসে? এতো বিষাদ কেন প্লেটে, চামচে, পিরিচে! গরম পানি ছেড়ে বেসিনে আমি ধুয়ে দেই দাগ। বিষাদের দাগ। গ্লাভস দুটো ভরে যায় ফেনায়। এটা ঠিক সাবানের শাদা নয়। ফেনা ফেনা দুধের শাদা।

অতিথিরা, এই যে, শুনতে পাচ্ছো কী! তোমরা কাল ও পরশু কিংবা আগামীতে আরো তো জঞ্জাল রেখে যাবে, আমরা ধুয়ে দেবো দুধের নহরে। ফ্রিজ খুব বেশি দূরে নয়। গ্যালন গ্যালন দুধ। সারি সারি করে সাজানো। একদিন মিখায়েল নিয়ে এলো একটা দুধের বোতল। মুখ খুলে বেসিনে ঢেলে ধুয়ে নিচ্ছে প্লেট আর চামচগুলোকে। এ কী করছে সে! আমি বাধা দিতেই আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো মিখায়েল। কাছে ডেকে নিয়ে বলে, দেখো রুমি কী সুন্দর সব ফর্সা হয়ে যাচ্ছে। চাইলে তুমিতো একটা বোতল নিয়ে আসতে পারো, পরিষ্কার হবে খুব, জানো! আমি ভাবি, কী বলে লোকটা!

পরের দিন ডন এলো রাত ৩টায়। মালিক বলে কথা! যেকোনো সময় সে চলে আসে। হঠাৎ দেখি মিখাইলের সঙ্গে ডন দাঁড়িয়ে। দুধে ধোয়া কাপ পিরিচ প্লেটগুলোকে দেখে মুচকি হাসছে! মালিকের বকা নয় বরং আশীর্বাদ পেলো মিখাইল। আমার শুধু ভয় হয়। কীসের যে এতো ভয়। ডনের সোনালি দাঁত, গেটের তারকাঁটা, নাকি দুধের নহর? নাহ আমার ঐ বেসিনের ভয়! যত গভীরে সেই গর্ত! আমার হাত, গ্লাভস, কিংবা পুরো শরীরটাই কী চলে যেতে পারে ভেতরে!

ডনের সঙ্গে মিখাইলের আশ্চর্য এক মিল দেখি আমি। নাহ চেহারা কিংবা পোশাকে নয়। ভাবে। ওরা নীচু স্বরে কথা বলে। মিনিট তিনেকের মত। হাসে দুজন। ডনের সাথে আমার কোন কথাই হয়নি। এমন কী ওর গলার স্বরটিও আমার খুব চেনা নয়। হয়ত কথা কম বলে। কিংবা নীচু স্বর তাই। অথচ রোজ আসে ডন। আমি কিছু জানতে চাইলেও ইশারায় উত্তর দেয় সে। কতবার বলেছি, খামটা রেখো না বেসিনের পাশে। ও শোনেনি। অথচ বেতনের খামটা সে রেখে যায় বেসিনের খুব কাছাকাছি কোথাও! এক তারিখে। বাতাসে নড়ে যায় খাম। আমি ভাবি গর্তে পরে গেলে আমি তো হারাবো খামটা। ওটা তুলতে যেয়ে হাতটাই হয়ত...! কাল হঠাৎ বললাম, ডন তুমি কী আমাকে অন্য কোন কাজ দিতে পারো, যেমন রেস্টুরেন্ট ভ্যাকুয়াম করা কিংবা অন্য কিছু? প্লেট ধোয়ার কাজ আমার আর ভালো লাগে না। আমি পারি না ভালো ওসব! উত্তরে ‘না’; বললো মিখায়েল। ডন কোন কথা বলেনি। আচ্ছা, ওরা কি বন্ধু কিংবা আত্মীয়? তাহলে মালিকের এত কাছাকাছি থেকেও একটা ভাল কাজ জোগাড় করতে পারেনি যে!

আজ ছ মাস হয়ে গেলো। এবার শীত পড়েছে খুব। আমার জ্বর চলে এলো পরশু। বেসিনের ভয়েও হতে পারে। দুদিন যাইনি কাজে। আজই ফিরলাম। ফিরতেই মিখায়েল আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কী সব বললো, আমি তেমন কিছুই বুঝিনি। ওর ভাঙা ভাঙা কথা আমি তেমন বুঝি না। রুমি, ডন তোমাকে খুঁজেছিল, তোমার কাজটাও এ দুদিন ডনই করেছে! বলে কী মিখায়েল! সোনালি দাঁতের মানুষটা ভালই তবে। এসব ভাবতে ভাবতে আমি কাজ শুরু করি। মিখায়েল দুধের বোতল নিয়ে এলো। তুমি কি ভুলে গেছো রুমি? নাহ, কিন্তু এত গ্যালন দুধ আমরা নষ্ট করি প্রতিদিন, তাই ভাবলাম শুধু পানি দিয়েই ধুয়ে নেবো আগের মতো।  

মিখায়েলের মুখ অন্ধকার। স্থির হয়ে ছিল সে। এখানে কাজ করতে হলে ডনের আদেশ তোমাকে মানতে হবে রুমি! চলে যাও তুমি। কাজটা ছেড়ে দাও। এবার অট্ট হাসি তার। কথাটা শুনে বোতলের মুখ খুলে নিলাম। পানির আর দুধে প্লেটগুলোকে ঢেলে ফেলি। চামচগুলো ঝনঝন করে বাজে। আমি ধুই বিষাদ। অবসাদ। অতিথিদের ফেলে যাওয়া ক্লান্তি। আমার শুধু ভয় হয়! বেসিনের ভয়! মিখায়েলকে বলবো ভাবছি। কি যে বলি! হাত হারানোর ভয়। আজ দুটো গ্লাভস পড়ি। একটার উপর আরেকটা! হাতে পানি ছোঁয়াবো না। পানিকেও ভয় হয় আমার। বেসিন আর পানির বন্ধুতাকে ভয়।

মিখায়েল প্রশ্ন করে। জোড়া গ্লাভসের প্রশ্ন। আমি ভয়ের কথা বলি। কথা থামিয়ে বলে, রুমি শাদা হও, ভয়কে দূরে রাখো। আমি কিছু একটা বলতে গিয়ে দেখি ডন আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর অন্য একটা হাত বেসিনে। পানি পড়ছে। সাথে দুধের নহর। প্লেট গোসলে আর কিছুটা হাত পুরে দিয়ে ডন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কী করছে সে! এভাবে মিনিট তিনেক থাকার পর আমি ওর হাতটা টেনে বের করি! ডন বেসিনের দিকে তাকিয়ে হাসে আর বলে, কাজ করো রুমি। কাজ!

পোকামাকড় নেই বললেই চলে। রেস্টুরেন্টটাতে। মাঝে মাঝে দু’একটা পোকা দেখতে পেলেও পায়ের তলায় মুচড়ে ফেলে ওরা। ওদের মতো আমিও। অথচ চাকরিটা ছেড়ে দেবার পর মেসের পোকাগুলোকেই পুষি আমি। দু’একটা পিঁপড়া আর টিকটিকিই সঙ্গী আজকাল। কত কত দুধের বোতল খালি করেছি। আর কত পানি এই রেস্টুরেন্টে। আর নয়।

বিকেলে তৈরি হই। ব্লু  জ্যাকেটটা পড়তে আরাম লাগে। শীত একটু কমে যায়। কে কবে রেখে ছিল সিগারেট। ড্রয়ারে ফেলে রাখা প্যাকেট! আমার মেসে থাকা পুরোনো কেউ কী! একমাস আগে এখানে শিফট করলাম। প্যাকেটটা নিয়েই বেরিয়েছি। রাস্তায় এক লোকের কাছে লাইটার নিলাম। একটা সিগারেট ধরাই। বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ হেঁটে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে। রেস্টুরেন্টের দরজায় পা রাখলাম। এই দরজায় প্রথম পা! চাকরিটা ছাড়ার পর অনেকবার ভেবেছি একবার আসবো এ পথে।  

ওয়েটার কাছে এলো। মেন্যু থেকে কী সব অর্ডার দিলাম! কিছুই চিনি না আমি শুধু খাবারের হাড়-কঙ্কাল ছাড়া। একটু পর ধোঁয়া ওঠা খাবার এলো। তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছি। স্যুপের বাটিতে চোখ রেখে ভাবছি কেউ কি চেনে আমায়। চেনার কথাও না। দু’একজন ছাড়া কেউ দেখেনি হয়তো কোনো দিন। ডনকে কোথাও দেখছি না। দেখা হলে হয়তো কথা বলবে না! আমার মতো এভাবে না জানিয়ে কেউ কি চাকরি ছেড়ে দেয়! দেখা হলে হয়ত কিছু একটা বলতে পারে আমার প্রাক্তন মালিক, সোনালি দাঁতের ডন! নাহ কোথাও কেউ নেই। আমার খাওয়া প্রায় শেষ। কিছু উচ্ছিষ্ট আমি মিখাইলের জন্যেই রেখে দিয়েছি। ও ধুয়ে নেবে বাবা চামচ, মা চামচ, প্লেট পিরিচ।  

বিলটা দিতে গিয়ে ওয়েটারকে ডাকি। একটা বোতল দিয়ে গেলো ও। আমিতো চাইনি কোন পানীয়! বলে গেলো, কম্প্লিমেন্টারি! গ্লাসে নিয়েছি কিছুটা। খাচ্ছি। অল্প অল্প! একা লাগছে খুব। উঠবো এখনই। মিখাইলের জন্যে কিছু উচ্ছিষ্ট রেখে যাচ্ছি। দুধের নহরে ধুয়ে নেবে মদ ও যাবতীয়। আমি উঠে যেতে পারছি না। আমার বিষাদ আমাকে ঠেলে ঠেলে বসিয়ে রাখছে।

সবাই চলে যাচ্ছে। অতিথিরা। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা প্রায়। আমি এখনো উঠতে পারছি না! হঠাৎ টের পাই কেউ আমাকে চেয়ার থেকে টেনে, পেছনের দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে! কিচেনের দিকে। টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। ওদের অনবরত লাথিতে শুয়ে পড়েছি আমি! মাটিতে কুঁজো হয়ে! পেট আর পিঠে ব্যথায় দাঁড়াতে পারছি না। ঝাপসা চোখে দেখি মিখাইল আর ডনের ছায়া! অকথ্য কিছু কথাও ঝাপসা হয়ে আসে।

সকালের আলো এসে ডেকে তোলে আমার ঘুমঘোর ব্যথাগুলোকে। জানালা নেই। নেই দরজাও। বন্ধ দরজার ওপাশে ডাস্টবিনে কাছেই একটা ভাঙা রোদ ঠেলে আসে চোখের উপর। দেখতে পাই আমার দু’পায়ে শিকল। স্টোররুম পর্যন্ত গেছে শিকলের নোঙর। খুব শক্ত করে বাঁধা। সন্ধায় মিখায়েল এলে কিছু উচ্ছিষ্ট খাবার আমাকে সামনে এগিয়ে দেয়। বেসিনের গর্তটাকে আর ভয় হয় না এখন। বিশাল ডাস্টবিন, গেটের তারকাঁটা, মালিকের সোনালি দাঁতগুলোকেও না!

আজ অব্দি দুটো হাত আমি নোংরা পানিতে ডুবিয়ে নাচি আর চামচের গোসল উপভোগ করি। তোয়ালে দিয়ে নরম হাতে গা মুছিয়ে দেই। এইতো জীবন। সাজাই চামচ সংসার। বাবা চামচ, মা চামচ, শিশু চামচ....।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ