ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফুটবল

অদম্য মেয়ে ফুটবলাররা শোনালেন সাফ জয়ের পেছনের গল্প

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২৩
অদম্য মেয়ে ফুটবলাররা শোনালেন সাফ জয়ের পেছনের গল্প

ঢাকা: ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা পেয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। গত বছর সেপ্টেম্বরে নেপালকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জিতেছে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা।

এরপর থেকে সাবিনা-শামসুন্নাহাররা এখন সবার চোখে মধ্যমণি। তবে এই পর্যন্ত আসতে যে সবারই নানান ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা এখন অনেকেরই জানা।

অদম্য এই মেয়েরা শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসরের একটি সেশনে শোনালেন ট্রফি জেতার সেই রেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের উঠে আসার গল্পও। এসময় সাফজয়ী কোচ ও মেয়েরা এসেছিলেন আয়োজনে। তাদের এই পর্যন্ত উঠে আসার অম্ল-মধুর গল্পতে পুরো সময়টুকু যেন দর্শকরা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছেন।

বাংলা একাডেমির লনে দুপুরে দর্শকদের সামনে উপস্থিত ছিলেন সাফজয়ী কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন, সহকারী কোচ মাহমুদা আক্তার ছাড়াও অন্যতম খেলোয়াড় শামসুন্নাহার জুনিয়র, রুপনা চাকমা, সোহাগী কিসকু ও ইতি রানী মণ্ডলসহ অন্যরা। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগও উপস্থিত ছিলেন।

শুরুতে জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন লিট ফেস্ট আয়োজকদের ধন্যবাদ দিয়ে সাফ জেতার নেপথ্যের কাহিনি শোনান। এসময় তিনি বলেন, ‘কোচের ভূমিকা কিছুটা তো আছে। এছাড়া সার্বিক টিমওয়ার্কের কারণেই এই সাফল্য এসেছে। ১০-১২ বছর ধরে মেয়েদের ফুটবলের পথচলা। ফুটবল ফেডারেশন শুরু থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে ফেডারেশন যুদ্ধ করে গেছে। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কঠোর অনুশীলনের মধ্যে রেখেছে সবাইকে। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে গেছে সবকিছু। সবার সহযোগিতায় এই পর্যন্ত আসা হয়েছে। ’

২০০৮ সহকারী জাতীয় পুরুষ দলের কোচ ছিলেন ছোটন। ২০১০ সালে ১১তম এসএ গেমসে নারী দল গঠন হলো। সেখানে বাফুফে থেকে নিয়োগ দেওয়া হলো তাকে।  

ছোটন বলছিলেন, ‘তখন নারী দলের পথচলা শুরু। চিন্তা ছিল এখানে কাজ করার জায়গা আছে, উন্নতি করারও। তখন ৬ জেলা থেকে ৩৬ জন খেলোয়াড় এসেছিল। মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে ট্রেনিং শুরু করি। সবাই বিভিন্ন ডিসিপ্লিন থেকে এসেছে। ভলিবল, হ্যান্ডবল, তায়কোয়ান্দোসহ অন্য খেলা। ’

এরপর যোগ করেন এভাবে, ‘৬-৭ মাস ট্রেনিং হয়েছিল। তখন ২০১০ সালে এসএ গেমস ফুটবলে ব্রোঞ্জ পদক পাই। সাফেও কক্সবাজারে সেমিফাইনালে খেলেছি। এরপর একটু একটু করে এগিয়ে চলা। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০২৪ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হবো। তার আগেই গত বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সবার চেষ্টাতেই এমনটি হয়েছে। ’

মেয়েরা যে আগে বেশ অবহেলিত ছিল সেই দুঃসময়ের স্মৃতি রোমন্থন করলেন ছোটনের সহকারী মাহমুদা আক্তার।

তিনি বলেন, ‘আমাদের জার্নিটা সহজ ছিল না। আমি সবার আগে একজন নারী। ছেলে হলে হয়তো সমস্যা ছিল না। আজকে দেশকে কিছু দিতে পেরেছি, তাই আমার গল্পটা সামনে আসছে। আগে যেমন অবহেলিত হতে হতো তা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। ’

তিনি বলেন, ‘আমার ২৪ ঘণ্টাই থাকা হয় ওদের সঙ্গে। আমার দুই কন্যা আমার মায়ের কাছেই থাকে। আমাকে সবটা সময় মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে থাকতে হয়। আমাদের জন্য কাজটা করা কঠিনই। ’

মেয়েদের কঠোর অনুশীলনে যে অনেক কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাও উল্লেখ করলেন একসময়ে জাতীয় দলে খেলা সাবেক এই ফুটবলার। বলেন, ‘মেয়েরা যতই ডায়েট করুক না কেন, একটুতো খেতে ইচ্ছে করে। দেখা যায়, খেতে ইচ্ছে করলেও খেতে পারি না। আমাকেও তো মাঠে খেলতে হবে। দিন শেষ দেশকে কিছু দিতে পারলে অনেক ভালো লাগে। সবমিলিয়ে দুর্দান্ত। ’

সফলতার আগে একসময় যাদের মুখ থেকে কটূ কথা শুনতে হতো ঠিক তারাই এখন বাহবা দিচ্ছে, তাদের মুখেই প্রশংসা ঝরছে।  

এমন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘মেয়েদের সম্মান আগের চেয়ে বেড়েছে। কোনও কাজ করার আগে সবাই বলবে তোমার দ্বারা হবে না, পারবে না। ছেলেদের দ্বারা হবে। তবে আমাদের চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। যখন সাকসেস হই তখন যারা অপমান করেছে, কটূ কথা বলেছে তারাও অভিনন্দন জানিয়েছে। ’

ছেলে-মেয়েদের সমান চোখে দেখার আহ্বান জানিয়ে মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘সবাইকে সমান চোখে দেখবেন। মনমানসিকতা বদলাতে হবে, যুগ বদলে যাচ্ছে। যখনই আমরা হাফ প্যান্ট পরি তখন বলে, ওটা ছেলেদের। তাহলে আমাদের কোনটা? তাহলে আমরা কি শুধু হাড়ি ও খুন্তি নাড়ব?একজন ছেলে যদি খেলতে পারে, তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়?’

ছোটন-মাহমুদরা যখন জীবনের গল্প বলছিলেন তখন মঞ্চের সামনে দর্শকরা মনোযোগী শ্রোতা। কথার ফাঁকে ফাঁকে হাততালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন।

দলের গোলরক্ষক ইতি মণ্ডল নিজের ক্যারিয়ারের নানান দিক তুলে ধরেন। পাশাপাশি দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়েছে। নিজের পরিচয়ে সবাই পরিচিত হতে চাইবে তা ইতির কথাতে প্রকাশ পেয়েছে বেশ সুন্দরভাবে।  

তিনি বলেন, ‘নিজের একটা পরিচয় সবাই চাইবে। আগে লোকে জানতো মনজিতের (বাবা) ছোট মেয়ে আমি। এখন সাফ জেতার পর বলে ইতির বাবা-মা। ভালোবাসা প্রকাশ করার একটা মাধ্যম লাগে। আপনারা আমাদের এতোটা ভালোবাসেন তা আগে জানতাম না, হয়তো বুঝতাম। এই সাকসেসের পর সেটা প্রকাশ পেয়েছে। ’

খেলার মাধ্যমেই যে অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিতি পাওয়া যায় সেটাও বললেন এভাবে- ‘একজন এমবিবিএস ডাক্তারকে কজন চিনতে পারে? কিন্তু খেলাধুলা একটা মাধ্যম, যা অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই চেনে, ভালো করতে পারলে। আমাদের পথচলা এখনও বাকি। সবার ভালোবাসায় আরও এগিয়ে যাব। ’

বাফুফে এই খেলোয়াড়দের কয়েক বছর ধরেই লালন-পালন করে আসছে পরিবারের মতো। সে কথা তুলে ধরে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ বলেন, ‘তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে। মেয়েরা ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পারিশ্রমিক পায় ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য। খ্যাতি-যশসহ সবকিছুই পাচ্ছে। আমাদের থকেও প্রতিমাসে কিছু সম্মানী দেওয়া হয়। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। মেয়েদের নিয়ে আমরা কাজ করছি। স্পন্সরের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছি। আপনারা সবাই নানানভাগে এগিয়ে আসলে পরবর্তিতে এশিয়াতেও ভালো করা সম্ভব এবং আমরা এখন সেটির স্বপ্ন দেখি। ’

শিরোপা জিতে সাবিনা-শামসুন্নাহাররা এখন সবার চোখে মধ্যমণি। তবে এই পর্যন্ত আসতে যে সবারই নানান ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা এখন অনেকেরই জানা। ঢাকা লিট ফেস্টে এসে সাফ জয়ী তারকা শামসুন্নাহার জুনিয়র নিজের জীবনের কষ্টার্জিত খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে ধরেন।

বাংলা একাডেমির লনে মঞ্চে বসে জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড বলেন, ‘এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। সাফ জিতে আসার পর দেশে ফিরে বুঝতে পেরেছি এই দেশের মানুষ ফুটবল কতোটুকু ভালোবাসে। ভালোবাসে আমাদেরকেও। যখন এসেছি তখন পুরো ঢাকা শহর ঘুরেছি। সবাই আমাদের বরণ করছে। জীবনে অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন সেটা। ’

দর্শকরা এই কথাতে হাততালি দিয়ে যেন আবারও তাদের অভিনন্দিত করলেন।

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা শামসুন্নাহার নিজের উঠে আসার কাহিনী শোনাতে গিয়ে যেন পেছনে ফিরে গেলেন। বলেন, ‘বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে শুরু করেছিলাম। স্যাররা খেলোয়াড় বাছাই করতো। মজায় মজায় খেলে শুরু করেছি। ভাবতাম খেলবো আবার বাসায় চলে যাবো। ফুটবলটা বোঝার চেষ্টা করেছি তখন। যখন একটু একটু বড় হচ্ছি, তখন বাসা থেকে বলতো আর যেও না। এটা মেয়েদের খেলা নয়। বাড়ি থেকে বকা দিতো। তখন লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যাগে বল নিয়ে যেতাম। বাসায় দেরিতে যাওয়ার কারণে মারও খেয়েছি। ’

বাসা ও অন্যদের কাছ থেকে আরও কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবার থেকে বলতো এটা ছেলেদের খেলা, আমি খেললে পাপ হবে। ২০১৭ সালে জাতীয় দলে প্রথমবার ডাক পাই। বাসা থেকে ক্যাম্পে চলে এসেছিলাম। বাসা থেকে দুয়েকদিন পরই বলতো চলে আসো। বলতো ফুটবল খেললে বিয়ে হবে না। আমি বলেছি বিয়ে না হলে না হবে। তারপরেও আমি খেলব। আসলে গ্রামের মানুষ অনেক কিছু বুঝত না। তাদের অনেকেই বাসায় বাবা-মাকে বোঝাতো আমাকে যেন খেলতে না দেওয়া হয়। আর হাফ প্যান্ট পরেই বা কেন খেলবো; তাও বলত তারা। ’

সাফ জেতার পর পরিস্থিতি একদম পাল্টে গেছে। যে শামসুন্নাহাররা বকা শুনতো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেলতো- তারাই সাফল্যের পর উল্টো চিত্র দেখেছে।

শামসুন্নাহার বলেন, ‘এবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাসায় গিয়েছি। তখন আমাকে দেখতে এসেছে সবাই। বাসায় ভিড় জমে গিয়েছিল, সবাই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছে। পেছনের গল্পটা শুনতে চেয়েছে। আসলে সবকিছুই এসেছে সাফল্য প্রাপ্তির পরই। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২৩
এইচএমএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।