ঢাকা, বুধবার, ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১১ জুন ২০২৫, ১৪ জিলহজ ১৪৪৬

ফুটবল

বাংলাদেশ ফুটবল: হারানো ভালোবাসার পুনর্জাগরণ

আবির রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, স্পোর্টস  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫২, জুন ১০, ২০২৫
বাংলাদেশ ফুটবল: হারানো ভালোবাসার পুনর্জাগরণ ছবি: কোলাজ

ফুটবলের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা আর কোনো খেলায় নেই। এটা সর্বজন স্বীকৃত।

পদ্মার পাড় থেকে পানামার জঙ্গল, চট্টগ্রামের পাহাড়ি ট্রেইল থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গ, বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তর থেকে মরুভূমির বুকে…যেখানেই যান, ফুটবলপ্রেমী কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন।  

আর বাঙালির ফুটবল আবেগ তো একেবারে আলাদা। নিকট অতীতে যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও উড়তে দেখা যেত বিভিন্ন দেশের পতাকা। প্রিয় দলের জার্সি পরে সমর্থন জানানো, প্রিয় খেলোয়াড়ের নামে ব্যানার-পোস্টার…এসব দৃশ্য হয়ে উঠত নৈমিত্তিক। নিজ দেশ ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে না থাকলেও পরদেশি কোনো দলের প্রতি এমন গভীর ভালোবাসা একমাত্র বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।

এক সময় দেশের ঘরোয়া ফুটবল ছিল মানুষের বিনোদনের অন্যতম উৎস। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ ঘিরে তর্ক-বিতর্ক জমে উঠত টং দোকান থেকে শুরু করে বাসার ড্রয়িং রুম পর্যন্ত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে দেশের ফুটবলের সেই জৌলুস ফিকে হয়ে যায়। গ্যালারি হয়ে পড়ে ফাঁকা, দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয় ঘরোয়া ফুটবল থেকে, আগ্রহ বেড়ে যায় বিদেশি লিগের প্রতি। ধীরগতির খেলার কারণে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে ঘরোয়া ফুটবল। অন্যদিকে কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় রঙিন হয়ে ওঠে ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক সাফল্য, সুদর্শন তারকা ক্রিকেটারদের আবির্ভাব এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ক্রিকেটকে এনে দেয় বিশেষ স্থান।

তবে ক্রিকেটকেও এই অবস্থানে আসতে সময় লেগেছে। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল; কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় সেই পথচলার সূচনা করে। তার অপরাজেয় ৬৮ রানের ইনিংস বদলে দিয়েছিল দেশের ক্রিকেট মানচিত্র।  

এরপর থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটে শক্ত অবস্থান তৈরি করে বাংলাদেশ। সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদ…তারা হয়ে ওঠেন দেশের ঘরের সন্তান। তবে সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেটও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। তারকাসংকট, ধারাবাহিকতার অভাব এবং মাঠের বাইরের বিতর্কে আলোচনার বদলে এখন ক্রিকেটে সমালোচনাই বেশি।

অন্যদিকে দেশের ফুটবলে দেখা দিয়েছে নতুন প্রাণ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী, ইতালির লিগে ফাহামেদুল ইসলাম, কানাডায় খেলা সামিত সোমদের আগমনে ফুটবলের গ্যালারি আবারও দর্শকে ভরে উঠেছে। টিকিটের জন্য মানুষের হাহাকার, বাফুফের সামনে সমর্থকদের অবস্থান কর্মসূচি…এসব দৃশ্য এখন আর নতুন নয়।

নতুন এই ফুটবল জাগরণ নিয়ে ক্রিকেটের সোনালি যুগের কান্ডারি আকরাম খান বলেন, ‘ফুটবলের আবেগ অন্য সব খেলার চেয়ে আলাদা। আবাহনী-মোহামেডানের অনুশীলনে যে দর্শক হতো, অনেক সময় তা ক্রিকেট ম্যাচকেও ছাড়িয়ে যেত। আমার বড় ভাই ফুটবলার ছিলেন, আমিও খেলেছি। হামজাদের আগমনে আবারও ফুটবলে সেই পুরোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যা সত্যিই আনন্দের। ’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘ক্রিকেট আর ফুটবল, দুটোই দেশের পতাকা বহন করে। এখন ক্রিকেট একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সময় লাগবে নতুন তারকা তৈরি হতে। আশা করি ফুটবলের এই জাগরণও ধরে রাখা যাবে। ’

ডেইলি সানের স্পোর্টস এডিটর আতিফ আজম বলেন, ‘আমি মনে করি না ফুটবল ও ক্রিকেটের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। এই দুটো একসাথে চলতে পারে। হামজা, সামিত, ফাহামেদুলদের আগমনে মানুষ আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তবে এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলতে হবে। সফলতা ছাড়া জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন। ’

তিনি আরও বলেন, ‘ফুটবল বিশ্বজুড়ে খেলা হয়, যেখানে ক্রিকেটের পরিসর সীমিত। তাই ফুটবলের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ’

সকাল-সন্ধ্যার ক্রীড়া সম্পাদক সনৎ বাবলা বলেন, ‘২০০৩ সালেও এমন জোয়ার দেখা গিয়েছিল, যখন সাফ শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সাংগঠনিক ব্যর্থতা, অব্যবস্থা আর অবহেলার কারণে সেই জনপ্রিয়তা টেকেনি। প্রবাসী ফুটবলাররা এবার শক্তি বাড়ালেও ভবিষ্যতের জন্য স্থানীয় খেলোয়াড়দের উন্নয়ন জরুরি। ’

সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি আরও জানান, ‘প্রবাসী খেলোয়াড়দের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের শিশুদের ফুটবল বিমুখ করে তুলতে পারে। স্থানীয় পর্যায় থেকে ২০০-৩০০ মানসম্পন্ন ফুটবলার তৈরি করতে হবে। ’

ফুটবল বিশ্লেষক আহমেদ শায়েক বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ সাফল্যপ্রেমী। ক্রিকেট বা ফুটবলে যখন সফলতা আসে, তখনই তারা আগ্রহী হয়। তবে লয়্যাল ফ্যানরা সবসময় খেলাটার সাথেই থাকে। এখন ফুটবলের প্রতি যে আগ্রহ, তা নতুন কমিটির ‘বিগিনারস লাক’ও হতে পারে। এটা টিকিয়ে রাখতে হলে চাই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং মাঠের প্রতি মনোযোগ। ’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্রিকেটের পতন শুরু হয় মাঠের বাইরের কার্যক্রম বেশি আলোচিত হলে। ফুটবলেও যদি বাই প্রোডাক্টগুলো প্রাধান্য পায়, তাহলে উন্নয়ন থমকে যাবে। ’

নতুন কমিটি ও বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে বর্তমানে মাঠের খেলা গুরুত্ব পাচ্ছে, যা ইতিবাচক। তবে এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ফুটবল ফিরে পাচ্ছে তার হারানো আবেগ, ঘরের আনন্দের উৎস হয়ে উঠছে আবারও। ক্রিকেট তার জায়গায় থাকবে, তবে ফুটবলের এই জাগরণ যেন ক্ষণিকের না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মাঠের খেলাই আসল। এটাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠুক নতুন দিনের বাংলাদেশের ফুটবল।

এআর/আরইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।