খেলোয়াড় হিসেবে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছিল আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার। কামিয়েছেনও দুই হাত ভরে।
বুধবার (২৫ নভেম্বর) রাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন ম্যারাডোনা। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর অনেকটা আড়ালেই ছিলেন তিনি। এ সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো এবং নিজ দেশ আর্জেন্টিনার অখ্যাত সব ক্লাবের কোচ হিসেবে তেমন আহামরি কোনো আয় হয়নি তার। কিন্তু তাতেও তার জীবনযাত্রায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। খরচের হাতে টান পড়লেও দমে যাননি তিনি। দামি ঘড়ি, কিউবান চুরুট, মদ আর মাদক ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতানো ম্যারাডোনা ক্লাব ফুটবলেও ছিলে হটকেক। ফলে যেখানেই গেছেন মোটা অংকের বেতন পেয়েছেন। অন্যান্য আয় মিলিয়ে যা লাখ লাখ ডলার। আর্জেন্টিনার ক্লাব বোকা জুনিয়র্স দিয়ে শুরু, এরপর গেছেন বার্সেলোনা, নাপোলির মতো ক্লাবে। সেখানে ইউরোপে একসময় তিনি ছিলেন সর্বাধিক আয় করা ফুটবলার। খ্যাতি আর অর্থ সবসময় তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু শেষ জীবনে তার হাতে কত অর্থ ছিল?
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমাস-এর রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, নাপোলিতে ক্লাব ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটানো ম্যারাডোনা বেতন পেতেন ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের বাণিজ্যিক দূত হিসেবে আয় করেছেন ১ কোটি ডলারের বেশি, যা এখনকার হিসাবে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ বেতন ও পণ্যের প্রচার মিলিয়ে তার আয় করা ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার এখন প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের সমান। এছাড়া বার্সা থেকেও পেতেন মোটা অংকের অর্থ।
কোচিং ক্যারিয়ারে অবশ্য আগের সেই জৌলুশ ছিল না ম্যারাডোনার। ২০১০ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ হিসেবে যা পেতেন তা আহামরি কিছু নয়। এরপর মেক্সিকোর নিচু সারির ক্লাবের কোচ হিসেবে পেতেন ১৫ হাজার মার্কিন ডলার, যা তার মাপের একজনের সঙ্গে বেমানান। এটা একসময় অতিরিক্ত বিলাসী জীবন কাটানো ম্যারাডোনার আর্থিক পতন সমান সামনে তুলে ধরে। এমনকি এক্সপ্রেস ডটকমের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, মৃত্যুর সময় এই কিংবদন্তির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল নাকি মার ১ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা মাত্র ৮৫ লাখ টাকা।
ম্যারাডোনার আর্থিক অবস্থার এই করুন চিত্র অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। ক্যারিয়ারে কর ফাঁকির কারণে বহুবার আইনি ঝামেলায় পড়েছেন তিনি। এর মধ্যে ইতালির এক আদালত কর ফাঁকির জরিমানা হিসেবে তাকে ২০০৫ সালে ৩ কোটি ৭২ লাখ ইউরো দিতে আদেশ দেন। এমনকি ২০০৯ সালে ইতালিতে গেলে কর আদায়ের অংশ হিসেবে তার শখের হীরের কানের দুল রেখে দেয় পুলিশ। যদিও পরে এক সাক্ষাৎকারে কর ফাঁকির ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন ম্যারাডোনা। তার দাবি ২০০৩ সালেই কর পরিশোধ করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অভিযোগটা সঙ্গী করেই বিদায় নিলেন তিনি।
মেক্সিকোর ক্লাব দোরাদোসের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আগে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর বেলারুশের ক্লাব দিনামো ব্রেস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু মেক্সিকো চলে যাওয়ায় ওই চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। ফলে শেষদিকে বেশ অর্থকষ্ট পোহাতে হয়েছে তাকে। অথচ একসময় বিশ্বখ্যাত জার্মান ক্রীড়াসামগ্রী ব্র্যান্ড পিউমার সঙ্গে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ ছিলেন তিনি। এমনকি কোকা কোলা, হাবলট এবং কোনামির মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর ছিলেন সাবেক এই আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।
ক্যারিয়ারে অঢেল আয় করলেও সেভাবে দান করতে দেখা যায়নি ম্যারাডোনাকে। তবে ইউনিসেফের বেশকিছু চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালে শিশুদের এক চ্যারিটির জন্য একটি ফুটবল ম্যাচে অংশ নিয়ে ৫ লাখ মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা সংগ্রহে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে দান করার অবস্থা হয়তো তার নিজেরই ছিল না। কারণ তার সম্পদের পরিমাণ দেখলেই বোঝা যায় কতটা কঠিন অবস্থায় কেটেছে তার শেষ দিনগুলো।
বিশ্বের প্রায় নামকরা সব ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরতে ভালোবাসতেন ম্যারাডোনা। প্রায়ই তাকে দু’হাতেই ঘড়ি পরতে দেখা যেত। সব সময়ই কানে হীরার দুল পরতেন ম্যারাডোনা। প্রিয় ছিল কিউবান চুরুট। ট্যাটু করেছিলেন তিনি। তার হাতে জায়গা করে নিয়েছে বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী নেতা চে গুয়েভারার মুখ। পায়ে ছিইল প্রিয় বন্ধু ও কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর মুখচ্ছবি। গ্যারেজে ছিল ফেরারি, রোলস রয়েস, পোরশে, অডিসহ অন্তত ১০টি গাড়ি। কিন্তু হায় শেষ বেলায় প্রায় খালি হাতেই দিন কেটেছে এই কিংবদন্তির।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
এমএইচএম