ঢাকা: এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, জনস্বাস্থ্যের শীর্ষ ১০টি হুমকির মধ্যে একটি হল অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর)।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রতিরোধ করা না গেলে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মানবজাতির জন্য মহাবিপর্যয় বয়ে আনবে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপর নাম অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ। এগুলো মানুষ এবং পশু-পাখির শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে, নয়তো ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার প্রতিরোধ করে।
যখন কোনো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও পরজীবী সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ওষুধে আর কাজ হয় না, তখন অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার সক্ষমতা অর্জন করা ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া।
এসব ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে এবং বংশবিস্তার করতে পারে। এতে মানুষ বা পশুর পাখির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সেরে যেত, সেটাতে আর কাজ করে না, বরং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন পরিস্থিতিকে বলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। এ পরিস্থিতিতে সংক্রমণের চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে ওঠে এবং রোগের বিস্তার ঘটে, অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বেশ কিছু রোগের জীবাণুর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এএমআর সার্ভিল্যান্স হালনাগাদ গবেষণায় মোট ২৭ হাজার ৪৩৮ জন রোগীর বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৮ শতাংশ জীবাণুর মধ্যে সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা পাওয়া যায়। চলতি বছরে পরীক্ষাকৃত ২৭৩টি নমুনার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যাকটেরিয়ায় এক ধরনের রাসায়নিক এনজাইম শনাক্ত হয়, যা ব্যাকটেরিয়া নিজে তৈরি করে এবং যা অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম।
এ বিষয়ে সরকারে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ওষুধের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলছে। এটা এত বেশি ভয়ানক যে, বলা হচ্ছে পরবর্তী মহামারী একারণেই হবে। তখন মানুষের অসুখ হবে, কিন্তু তার কোনো ওষুধ থাকবে না। তখন ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এটা একটা ভয়াবহ মহামারির মতোই বিপদজনক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োাটিক রেজিস্ট্যান্ট হয় তার মধ্যে অন্যতম হল বিনা প্রেসক্রিপশনে ঘনঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন। পুরো কোর্স শেষ না করে মাঝপথে খাওয়া বন্ধ করা। প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োাটিক গ্রহণ। ভাইরাসজনিত যে অসুখ একটি নির্দিষ্ট সময় পর সেরে যেত, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া। অন্যদিকে আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তা থেকেও আমাদের শরীরে এন্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিশ্বব্যাপী মহাবিপর্যয় ডেকে আনছে, তবে আমাদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ, কারণ আমাদের সংক্রমণরোধক ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়। পাশাপাশি আমাদের এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বেশি এবং একই সঙ্গে ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক বিভিন্ন প্রচারণা রয়েছে। খাদ্য দ্রব্য থেকেও আমাদের শরীরে এন্টিবায়োটিক ঢুকছে। হাজার টাকার এন্টিবায়োটিক, এমনকি লাখ টাকার এন্টিবায়োটিকেও রেজিস্ট্যান্ট তৈরি হয়ে গেছে বলে প্রায়ই রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কয়েক দশক থেকে নতুন কোনো এন্টিবায়োটিক তৈরি হয়নি, আগেরগুলোই কিছু সংযোজন বা মডিফাই করে ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি না হওয়াটাও একটা বিপর্যয়। নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি না হওয়ার কারণ হচ্ছে, কোম্পানিগুলো সব সময় এমন ওষুধ তৈরি করতে চায় যেটা আজীবন চলবে। কিন্তু এন্টিবায়োটিক তৈরি করলে, সেটার বিরুদ্ধে তিন চার বছরের মধ্যে রেজিস্ট্যান্ট তৈরি হয়ে যেতে পারে। তাই কোম্পানিগুলো নতুন এন্টিবায়োটিকে বিনিয়োগ করতে চায় না। সবকিছু মিলে সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র ও পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে আমাদের বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে। আমরা সার্ভে করে দেখেছি, অনেকেই এন্টিবায়োটিক চেনেন না। সহজেই চেনার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের মোড়কে লাল রঙয়ের এন্টিবায়োটিক লেখা থাকবে। এন্টিবায়োটিক বিষয়ে আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। রোগী যেন এন্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন করেন, তার জন্য বিভিন্ন কোর্স হিসেবে এন্টিবায়োটিক বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে, খুচরা এন্টিবায়োটিক কেউ কিনতে পারবেন না।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, আইসিইউতে এমন কিছু রোগী পাওয়া যায়, যাদের সব ধরনের এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে, এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এমন যদি হতেই থাকে এবং নতুন কোনো এন্টিবায়োটিক যদি না তৈরি হয় তাহলে এটা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রতিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। সবাইতো আর যোগ্যতাসম্পন্নচিকিৎসক নয়। চিকিৎসকদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে রোগীকে এন্টিবায়োটিক দেওয়ার ক্ষেত্রে। অনেক রোগী আবার নিজেরাও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খান। রোগীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এন্টিবায়োটিকের পূর্ণ কোর্স শেষ করতে হবে। ওষুধের দোকানের দায়িত্ব হচ্ছে যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রি না করা। ওষুধের দোকানে সনদধারী ফার্মাসিস্ট থাকে না, এটা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। ডাক্তার, রোগী, ফার্মাসিস্ট এবং প্রশাসন সবাই সমন্বিতভাবে যার যার দায়িত্ব পালন করলে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নির্মূল না করতে পারি, অন্তত ঝুঁকি কমাতে এবং প্রতিরোধ করতে পারব।
(এই প্রতিবেদনটি বিএনএনআরসির তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য সাংবাদিকতায় মিডিয়া ফেলোশিপের আওতায় তৈরি)
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২২
আরকেআর/এমএমজেড