ঢাকা: ‘আমি রাতে ঘুমাতে পারছি না, ঘুমের ঘোরে আমার চোখে বারবার ভেসে উঠে বিভিন্ন ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আর নিহত ছেলেগুলোর নিষ্পাপ চেহারা। আমারও দুটি বাচ্চা আছে।
রাজধানীর উত্তরায় বসবাসকারী একটি বায়িং হাউসের কর্মী দুই সন্তানের জননী সানজিদা আক্তার বাংলানিউজকে এভাবেই তার বর্তমান মানসিক অবস্থার বর্ণনা করেন।
মাঠপর্যায়ের সাংবাদিক আশেকিন প্রিন্স। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পেশাগত কারণে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের কর্মীর মতোই সরাসরি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সংবাদকর্মীরা ঘটনাগুলো সরাসরি দেখেছি, আমরা পুলিশের গুলিবর্ষণও দেখেছি, আবার আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ইটপাটকেল বা লাঠিসোঁটা দিয়ে আক্রমণও করার দৃশ্যও দেখেছি। এসব দেখার ফলে শুধু সাংবাদিক হিসেবে নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও মানসিকভাবে আমি ভীষণ হতাশাগ্রস্ত। আমি দেখেছি যারা মারা গিয়েছে তাদের বেশিরভাগ কম বয়সী এবং নিরপরাধ। আমরা চাই না এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটুক।
শুধু সানজিদা আকতার বা আশেকিন প্রিন্স নন, বর্তমান সময়ে অনেকেই; বিশেষ করে যারা বাবা-মা, তাদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পক্ষের নানা বক্তব্য রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত ১৪৭ জনের প্রাণহানির তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিহতের সংখ্যা অন্তত ২৬৬ জন। অন্যদিকে একটি মানবাধিকার সংগঠনের ধারণা, নিহত ২৫০ জনের কম নয়। কোনো কোনোও পরিবার দাবি করেছে, তাদের স্বজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। আবার অনেকেই নিহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন। নিহত এবং আহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গুজবও রয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে।
কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মেট্রোরেল, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ডেটা সেন্টার, বিআরটিএ ভবন, বিটিভি ভবন, হাসপাতাল, কারাগার, থানাসহ অনেক স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক সরকারি-বেসরকারি ভবন। বিভিন্ন মাধ্যমে এসব নৃশংসতার ভিডিও দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন।
সারা দেশে এসব সহিংসতা, হামলা, ভাঙচুর ও হতাহতের ঘটনায় তীব্র মানসিক সমস্যায় ভুগছে শিশু, কিশোরসহ সব বয়সী নারী-পুরুষ। পাশাপাশি দেশে চলমান কারফিউ (শিথিল) এবং স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে ঘরবন্দি মানুষেরও বিভিন্ন মানসিক সমস্যা বাড়ছে।
চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের নৃশংসতা বা ভয়াবহতার ভিডিও, নিহত-আহতের ঘটনা, সরাসরি গুলি করার দৃশ্য কোমলমতি শিশু-কিশোরসহ যেকোনো ধরনের সুস্থ মানুষের মন ভারাক্রান্ত, অশান্ত এবং বিষাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ইতোমধ্যেই অনেকের মধ্যেই মানসিক অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই ঠিকমত ঘুমাতে পারছেন না, দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠছেন। ইতোমধ্যে এ ধরনের রোগী ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য আসা শুরু হয়েছে বলেও জানা যায়।
কোটা আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট ঘটনা দেশের মানুষের মনোজগতে কী প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এমন ঘটনায় সবার মনের ওপরেই বড় ধরনের প্রভাব পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। সহিংসতায় বেশ কিছু শিশু নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে, এতে শিশু-কিশোরদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমরা যারা বয়স্ক, তারাইতো গত কয়েকদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি, আমরা বড়রা এটা সামাল দিতে পারলেও বাচ্চারা সেটা পারে না।
এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, নানান ধরনের হতাহতের ঘটনা, অনলাইনে বিভিন্ন সহিংসতার ভিডিওগুলোর ফলে যেকোনো সুস্থ মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে। শিশু-কিশোর-তরুণসহ সবার মনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারও কারও মধ্যে আমরা দেখছি এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ খেতে, ঘুমাতে পারছে না, দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠছেন। এমন রোগী চিকিৎসকের কাছে আসছে। অনেক মাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি নিহত শিশুটির জায়গায় নিজের সন্তানকে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছেন এবং চিৎকার করে জেগে উঠছেন।
তিনি বলেন, অন্যদিকে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের অবসাদ বা বিষণ্ণতা দেখা যাচ্ছে। সবমিলে বলা যায়, এসব ঘটনার ফলে তরুণ প্রজন্ম হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্যমের জায়গায় ফাটল ধরছে। অন্যদিকে পরিবারের বড়রা পুরো বিষয়টা নিয়ে হতাশ এবং বিষণ্ণ, যার ফলে একটা বিষণ্ণ পারিবারিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। যা শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিক বিকাশের অন্তরায়। সামগ্রিক অবস্থা একদিকে শারীরিকভাবে অনেককে প্রভাবিত করেছে, মৃত্যু ও আহতের মতো ঘটনা ঘটেছে, তেমনি অন্যদিকে পুরো প্রজন্ম যাদের বয়স ২৫ এর কম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক উভয়েই নেতিবাচক প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এ প্রভাব অনেক দিন সমাজে চলমান থাকবে।
কোটা আন্দোলনের ফলে দেশের মানুষের ওপর কী ধরনের মানসিক প্রভাব পড়ছে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোটা আন্দোলন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এতগুলো মৃত্যু, কারফিউ, ইন্টারনেট ও স্কুল-কলেজ বন্ধ, বিভিন্ন পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়া সমস্ত কিছু আমাদের সবার ওপরেই মানসিক চাপ তৈরি করছে। বিশেষ করে যারা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা আইন শৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন, সংবাদকর্মী যারা সরাসরি এসব ঘটনার নিউজ করেছেন, এমনকি যারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছেন সেসব চিকিৎসকদের ওপরেও মানসিক চাপ তৈরি হয়।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা মানুষের মানসিক এ অবস্থাকে বলে থাকি তীব্র মানসিক চাপ। আর যখন এটা দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস পরে হয়, সেটাকে আমরা বলি পোস্ট ট্রমাটিক স্টেজ ডিসঅর্ডার। এমন মানসিক চাপের কারণে আমাদের ঘুম কম হবে, মনোযোগ কমে যাবে, আচরণের বৈকল্য দেখা দেবে, অনেক সময়ে আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে। এর ফলে শিশুরা এক ধরনের ভীতি নিয়ে বড় হবে। এসব শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় ব্যক্তিত্বের সমস্যাও দেখে দিতে পারে।
এমন মানসিক অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে সব পক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল-কলেজ খুলে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরত যেতে হবে, রাতে জেগে থাকা যাবে না, সময়মতো ঘুমাতে এবং খাবার খেতে হবে।
চিকিৎসকরা আরও বলছেন, আমাদের মনের অবস্থাকে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে, এটাকে চাপিয়ে রাখা যাবে না, প্রত্যেকে নিজস্ব জায়গা থেকে শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে, কোনো ধরনের সহিংসতায় জড়ানো যাবে না। কোনো কিছুতেই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা যাবে না, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানসিক সমস্যার মাত্রা বেশি হলে প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২৪
আরকেআর/আরআইএস