ঢাকা, সোমবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৬ মে ২০২৫, ২৮ জিলকদ ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

জরায়ুমুখ ক্যানসার: অঞ্চলভেদে পার্থক্য সর্বনিম্ন ২.৫৬, সর্বোচ্চ ৭.১ শতাংশ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৮, মে ২৫, ২০২৫
জরায়ুমুখ ক্যানসার: অঞ্চলভেদে পার্থক্য সর্বনিম্ন ২.৫৬, সর্বোচ্চ ৭.১ শতাংশ

ঢাকা: জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রধান কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস সংক্রমণের হার অঞ্চলভেদে পার্থক্য সুস্পষ্ট, সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ১ শতাংশ।

রোববার (২৫ মে) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচির উদ্যোগে আয়োজিত তথ্য ও বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল প্রকাশসহ প্রকল্পের বিস্তার, অগ্রগতি, সফলতা, সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা জনসম্মুখে তুলে ধরা বিষয়ক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।



অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচআর-এইচপিভি) সংক্রমণের হার এখনও তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য সুস্পষ্ট। এর হার সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।  

এই গবেষণাগুলোর ফলাফল দেশের জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের কার্যকর উন্নয়ন এবং নীতি-নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা সরকার, স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ স্ক্রিনিং কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে উপকূলীয় এবং উচ্চ-প্রকোপযুক্ত অঞ্চলে (সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম) এইচআর-এইচপিভি স্ক্রিনিং চালু করা, গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে সমান গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিনিং সম্প্রসারণ, ৩৫-৪৪ বছর বয়সীদের অগ্রাধিকার, জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে সংযুক্ত স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্মের উন্নয়ন, ভায়া ও এইচপিভির সম্মিলিত পদ্ধতির মাধ্যমে ট্রাইএজ এবং ফলো-আপ নিশ্চিতকরণ, ল্যাবরেটরি ও হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্টিংকে ই-এইচআইএসের সাথে যুক্ত করা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়।

বিএমইউয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর-ই-ফেরদৌসের নেতৃত্বে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের তিনটি জেলায় (ঝালকাঠি, কক্সবাজার, বাগেরহাট) বিবাহিত ৯শ জন নারীর মধ্যে এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণের হার ছিল ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, সংখ্যায় ২৬ জন। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ পাওয়া গেছে ঝালকাঠিতে ৩ দশমিক শূন্য শতাংশ। সবচেয়ে বেশি পাওয়া জিনোটাইপ ছিল এইচপিভি ধরণ ১৬ (৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ)। গবেষণাটি এই অঞ্চলে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে জিনোটাইপিংভিত্তিক স্ক্রিনিং প্রবর্তনের সুপারিশ করে।

বিএমইউয়ের ডা. শিরিন আক্তারের নেতৃত্বে শহর ও গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে পরিচালিত তিন হাজার ৮৫৬ জন নারীর ওপর একটি বিশ্লেষণাত্মক গবেষণায় দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণের হার ছিল তিন দশমিক ছয় শতাংশ, সংখ্যায় ১শ ৩৮ জন। সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল সিলেটে (৬ দশমিক ৪শতাংশ) এবং সর্বনিম্ন রাজশাহীতে (১ দশমিক ৭ শতাংশ)। সিলেটের গ্রামীণ অঞ্চলে সংক্রমণ ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যা শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি। গবেষণায় ৩৫-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার সর্বাধিক পাওয়া যায়।

মুগদা মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. জাকান্ত ফাইকার স্ক্রিনিং পদ্ধতির তুলনা বিষয়ক গবেষণায়, চার হাজার ৭৯২ জন নারীকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে ভায়া প্লাস এইচপিভি এবং শুধু এইচপিভি স্ক্রিনিংয়ের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয়। ভায়া প্লাস এইচপিভি পদ্ধতিতে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ পজিটিভ পাওয়া গেলেও শুধু এইচপিভিতে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। একত্রিত পদ্ধতিতে রোগ শনাক্তকরণ ও ফলো-আপের হার বেশি ছিল, যা স্ক্রিনিং কার্যক্রমের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

দুটি উপজেলায় জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি পরীক্ষাবিষয়ক একটি পাইলট গবেষণা পরিচালনা করেন ডা. আসমা আক্তার সোনিয়া।

দেশে জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে জিনোটাইপসহ উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি পরীক্ষার ভূমিকা চিহ্নিত করাই এর উদ্দেশ্য। প্রতিটি গবেষণা এলাকা থেকে ৩০-৬০ বছর বয়সী ১০ হাজার নারীদের নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। গবেষণার ফলাফলে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, সংখ্যায় ৩শ ১৮ জন নারীর এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণ রয়েছে। সব নারীদের মধ্যে, ১ শতাংশ, সংখ্যায় ৯৭ জন নারীর এইচপিভি ধরন ১৬ এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ, সংখ্যায় ২০ জন নারীর এইচপিভি ধরন ১৮ ছিল। এই গবেষণায় এইচআর-এইচপিভির প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে কম (৩ দশমিক ২ শতাংশ)। ভায়ার তুলনায় এইচআর-এইচপিভি পরীক্ষা উচ্চ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে বলে প্রমাণিত।

স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং বিষয়ে ডা. সাদিয়া রসুলের গবেষণায় ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন (সিবিই)  এবং ম্যামোগ্রাফির সংমিশ্রণে স্তন ক্যানসার শনাক্তকরণে উচ্চ সংবেদনশীলতা (৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ) এবং নির্দিষ্টতা (৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ) দেখা যায়, যা প্রাথমিকপর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণে সিবিইর গুরুত্ব নির্দেশ করে।

জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিএমইউয়ের অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার নেতৃত্বে রাজশাহী বিভাগে ডিএইচআইএস২ ভিত্তিক একটি ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থার ই-এইচআইএসের মাধ্যমে স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত, দেশের ১৪ হাজার ২১৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে স্ক্রিনিং, কলপোস্কোপি এবং ট্র্যাকিংয়ের মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে।

তিনি আরও জানান, জরায়ুমুখে ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য ৬০ লাখ ৯৩ হাজার ২২৪ জন নারীর ভায়া পরীক্ষা করে দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩৫৮ জনের পজিটিভ পাওয়া যায়, শতকরা হিসেবে এ হার ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশে লক্ষ্য মাত্রার ২১ শতাংশ নারীকে স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

দুটি পর্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রথম পর্বে গবেষণাগুলোর ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। প্রথম পর্বে সভাপতিত্ব করেন বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএমইউর ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএমআরসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. নূরে আলম সিদ্দিকী।

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ।

বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রতিরোধ কার্যক্রম বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক (ইপিসিবিসিএসপি) অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে ও চিকিৎসাসেবাকে মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসারের পূর্বাবস্থা নির্ণয় করতে পারলে অনেক মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে। ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচির কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানে সেরা কমিউনিটি ক্লিনিক, সেরা ভায়া ও সিবিই কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৪৬ জনকে পুরস্কৃত করা হয়।

আরকেআর/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।