ঢাকা: ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এশিয়ার বহু দেশে রহস্যজনক এক মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এ মহামারী সাধারণ জ্বর, গলাব্যথা ও কাঁপুনি দিয়ে শুরু হলেও এক সপ্তাহ পর দেখা দেয় ফুসফুসের সংক্রমণ।
বিশেষজ্ঞরা এ রোগের নাম দেন সার্স (SARS) বা ‘Severe Acute Respiratory Syndrome’। হামবুর্গ শহরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগবিষয়ক ইন্সটিটিউটের ভাইরাসবিদ ক্রিস্টিয়ান ড্রোসটেন সেই সময় সার্স রোগের জীবাণু বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রাণীর দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাদুড়ই হল এই সব ভাইরাসের বাহক।
গবেষকরা বাদুড় বাহিত ভাইরাসের ডিএনএ পরীক্ষা করে লক্ষ্য করেছেন, এগুলো মানুষকে আক্রান্ত করার অনেক আগে থেকেই বাদুড়ের দেহে বসবাস করে আসছিল। শুধু সার্স নয়, এবোলা, জলাতঙ্ক, ঠাণ্ডা লাগা, ডায়রিয়া ইত্যাদি অনেক রোগের বাহকই বাদুড়। ভাইরাসদের বসবাস করার একটা আদর্শ স্থান বাদুড়ের শরীর। এর কারণ প্রথমত, তাদের সংখ্যাধিক্য। ১০ লক্ষের বেশি বাদুড় একসঙ্গে বসবাস করে। দ্বিতীয়ত, বাদুড় স্তন্যপায়ী জীব।
সম্ভবত বাদুড়ের মল থেকে মানুষের দেহে পৌঁছে যায় এই ভাইরাসগুলি। এশিয়ার কিছু দেশে মানুষ বেড়ালের মত দেখতে ‘ভিভাররাডে` নামের এক জাতীয় প্রাণীর মাংস খায়। তারা আবার বাদুড় খেয়ে থাকে। এভাবে এশিয়ার অনেক দেশে সার্সের ভাইরাস মানুষের দেহেও বিস্তার লাভ করে। বাদুড়ের দেহ থেকে মানুষের দেহে ঢুকতে গেলে ভাইরাসদের কীভাবে পরিবর্তন হয়, সে ব্যাপারেই গবেষকদের আগ্রহ বেশি। এই পরিবর্তনের রকমটা বুঝতে পারলেই বাদুড়ের দেহের জীবাণুগুলিকে খুঁজে পাওয়া ও পরীক্ষা করাও সহজ হবে। বোঝা যাবে মানুষের জন্য তারা কী বিপদ বয়ে আনতে পারে।
ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বলা সম্ভব হবে, কোন আস্তানায় ও কোন এলাকায় বিপজ্জনক ভাইরাসগুলি জায়গা করে নেয়। এখনই এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করা উচিত, কীভাবে এই সব ভাইরাসের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। ``
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সার্সের মত নতুন ধরণের করোনা ভাইরাস মানবদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে। তবে দীর্ঘদিনের সংশ্রবেই কেবল এ সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ জুড়ে এ ভাইরাসে মারা গেছে অন্তত ১৮ জন। রোববার ফ্রান্সে আরেকজনের দেহে এ ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। ফ্রান্সে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত অপর মানুষটির সঙ্গে একই হাসপাতাল কক্ষে থাকার পর দ্বিতীয় ব্যক্তির দেহেও এ ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে।
সার্স ভাইরাসের মতোই নতুন একটি ভাইরাসে দু’জন আক্রান্ত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। মূলত সার্স ভাইরাসের গোত্র থেকে নতুন এই এনসিওভি ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে।
মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বিবৃতিতে জানানো হয় কাতারের ৪৯ বছর বয়সী এক নাগরিক সৌদি আরবে ভ্রমণে যান। সেখান থেকে দেশে আসলে তার মধ্যে হঠাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ কিডনি বিকল হওয়া রোগ দেখা দেয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি নভেল করোনা ভাইরাসে (এনসিওভি) আক্রান্ত হবার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপর তাকে চিকিৎসার জন্য বৃটেনে পাঠানো হয়। ২ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
বৃটিশ হেলথ প্রটেকশন এজেন্সির (এইচপিএ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আক্রান্ত লোকটিকে পরীক্ষা করে, বছরের শুরুতে মারা যাওয়া সৌদি নাগরিকের সঙ্গে ৯৯.৫ ভাগ মিলে যায়, এমন ভাইরাস পাওয়া গেছে। এর আগে সৌদি আরবে এক ব্যক্তি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে সংবাদ প্রকাশ করে বিবিসি।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থার বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জন ওয়াটসন জানিয়েছেন, ভাইরাসটি একজন থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে কিনা এখনো তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জনসাধারণ কিংবা ভ্রমণকারীদের উদ্দেশেও কোনো সতর্ক বার্তা প্রকাশ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখছেন।
তবে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই বলে জানিয়েছেন একজন বৃটিশ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
ইউরোপের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে এনসিওভি খুব সহজেই মানুষকে আক্রমণ করতে পারে। তবে তারা ধারণা করছেন সার্স রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ দিয়েই এই ভাইরাসের সংক্রমণ দূর করা সম্ভব। নতুন কোথাও এ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ তাদেরকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
লেখক পরিচিতি: নিবন্ধটির লেখক মো.আরিফুর রহমান ফাহিম দেশের প্রখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর