চট্টগ্রাম: এইচআইভি ভাইরাস ধরা পড়লেই নিশ্চিত মৃত্যু! আক্রমন করবে আশপাশের লোকজনকে। আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশে যাওয়া যাবে না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ধারণা ভ্রান্ত। শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের জীবানু নিয়েই পার করা যায় দীর্ঘ জীবন। ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত এইচআইভি ভাইরাস নিয়ে অনেকের বেঁচে থাকার নজির রয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা।
চিকিৎসকরা বলছেন, সামাজিক অপবাদ বৈষম্য দুর করতে পারলেই এইচআইভি কমানো সম্ভব। সুস্থ নিয়মতান্ত্রিক ও সঠিক চিকিৎসা নিলে এইচআইভি নিরাময়যোগ্য। এইচআইভি ভাইরাস নিয়ে বেঁচে থাকা যায়।
ইউএনএইডস’র এইচআইভি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মুনির আহমেদ‘র মতে এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধে গণসচেতনতার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে এইচআইভি ও এইডস আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগের কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইচআইভি ও এইডস আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে।
এই সংখ্যা আরো কমানোর লক্ষে বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরকার এর চিকিৎসা সেবা প্রদানের উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান তিনি।
এইচআইভি এইডস বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ সামাজিকভাবে রক্ষণশীল হওয়ায় এদেশে এইচআইভি সংক্রমনের প্রবণতা অনেক কম। এখন বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্তের হার শুন্য দশমিক এক শতাংশ। দেশে যে ক’জন এইচআইভি পজেটিভ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের অধিকাংশই (৬০শতাংশ) দেশান্তরিত (মাইগ্রেশন) থাকাকালে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রন্ত হয়েছেন। ’
সম্প্রতি একটি সভায় ইউএনএইডস’র কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর লিও কেনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধে সরকারিভাবে নীতিমাল তৈরি করেছে।
ডা. মুনির আহমেদ আরো জানান, বাংলাদেশে ইনজেকশনের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ায় মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ২০১২ সালে বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত ৩৩৮ জন এবং এইডস আক্রান্ত ১০৩ জন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২১৩ জন পুরুষ, ১১৮ জন নারী। অন্যান্য ৭জন।
ইউএনএইডস‘র ২০১২ রিপোর্টের তথ্য মতে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৭১ জন এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছে। এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ২০১ জন। আর এ রোগের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩৯০ জনের।
এইচআইভি ভাইরাস নিয়ে বেঁচে থাকা যায়:
শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের উপস্থিতি মানেই নিশ্চিত মৃত্যু এমন ধারণা রয়েছে সমাজে। অনেক চিকিৎসকের মাঝেও রয়েছে এমন ধারণা।
কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরে এইচআইভির উপস্থিতি মানেই মৃত্যু নয়। নিয়মতান্ত্রিক ও সঠিক চিকিৎসা নিলে এইচআইভি নিরাময়যোগ্য। এমনকি শরীরে এইচআইভি ভাইরাস নিয়ে পার করা যায় দীর্ঘ জীবন।
ডা. মুনির আহমেদ বলেন, ‘এইচআইভি এইডস এমন একটি যৌনযোগ যার কোন চিকিৎসা নেই সমাজে অনেকের মধ্যেই এ ধারণা রয়েছে। বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ’
তিনি বলেন,‘নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা নিলে এইচআইভি নিরাময়যোগ্য। এমনকি এইচআইভি নিয়েই দীর্ঘ জীবন পার করা যায়। নিয়মিত ঔষধ সেবন করে অনেকে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে এ ভাইরাস নিয়ে বেঁচে আছেন। ’
গর্ভবতী অবস্থায় এইচআইভিতে আক্রান্ত হলেও নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে দেহ থেকে সন্তানের দেহে এইচআইভি সংক্রমনের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনা যায় বলে জানান তিনি।
অপবাদ বৈষম্য দূর হলে কমবে এইচআইভি:
অপবাদ বৈষম্য দুর করতে পারলেই এইচআইভি ভাইরাস কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। ফলে অনেকেই জেনেও তা প্রকাশ করেন না। চিকিৎসাও নেন না। এক্ষেত্রে নারীরা বেশি অপবাদ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, যে কেউ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। তারা সমাজের অন্য সব মানুষের মতই স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার রাখে।
এইচআইভ আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে চলাফেরা করলে, তার হাত ধরলে বা একই বাথটাবে বসলে এমন কি এইচআইভ আক্রান্ত নারী-পুরুষকে চুম্বন করলেও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিবাহিত নারীরা বর্তমানে এইচআইভিতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে ডা.মুনির বলেন, লিঙ্গ বৈষম্য, দারিদ্র এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এইডস মহামারীকে তরান্বিত করে। এ অপবাদ নারীদের মর্ম যাতনায় ফেলে এবং বৈষম্য দরিদ্রতা বাড়ায়।
তিনি বলেন,‘যখন একজন নারী এইচআইভি আক্রান্ত হয় তখন পুরো পরিবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর যখন একটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন নারীকেই সবচেয়ে বেশি দায় বহন করতে হয়। ‘
এজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি পয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বিবাহিতদের মধ্যেই বেশি:
ইউএনএইডসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১২ সাল এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩৮ জন। এরমধ্যে ২১৩জন পুরুষ, নারী ১১৮জন ও অন্যান্য ৭জন।
এইচআভি আক্রান্তদের মধ্যে দেখা গেছে বিবাহিতদের সংখ্যাই বেশি। শতকরা হারে ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ। অবিবাহিতদের মধ্যে এ সংখ্যা ২২ দশমিক ৫শতাংশ।
চিকিৎসকরা বলছেন যারা নিয়মিত যৌন মিলন করছেন তাদের মধ্যেই এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে নিরাপদ যৌনকাজ এইচআইভি প্রতিরোধ করে। এজন্য কনডম এখনও কার্যকর পদ্ধতি।
ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম:
এইচআইভি ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি লোকের বাস হলেও সেখানে এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে ১২৮ জন। তার বিপরিতে ৫০ লাখ লোকের বাস যেখানে সেই চট্টগ্রামেই সনাক্ত হয়েছে ৮৪ জন।
এছাড়া খুলনা বিভাগে ৬০জন, সিলেটে ৪১জন, বরিশালে ১২জন, রাজশাহীতে ৬জন, রংপুরে ২জন রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, যারা এইচআইভি ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের সচেতন করতে না পারলে এ সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে।
দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে জেলাখানায়:
ডা.মুনির বলেন, প্রবাসীদের মাধ্যমেই এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায় বেশি। তাদের সচেতন করে তুলতে না পারার কারণেই এমন হয়েছে। বিদেশ গমনের আগে তাদের কাউন্সেলিং করলে এ ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
এছাড়া ইনজেকশানে মাদক সেবনের কারণেই এইচআইভি ছড়াচ্ছে। কারণ মাদকসেবিরা ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে। এক্ষেত্রে তারা একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করে। ফলে মাদক সেবিরা সবচেয়ে বেশি এইচআইভি ঝুঁকিতে রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন মাদকসেবি একজন রোগী। চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের ভালো করে তোলা যায়।
এদিকে জেলখানায় এইচআইভি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন জেলাখানায় একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করার কারণে সেখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
এছাড়া যারা একই সঙ্গে যৌনকাজ ও মাদকসেবনে আসক্ত তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। একই সঙ্গে পুরুষ সমকামীদের মাঝেও এইচআইভি সংক্রমনের হার দ্রুত বাড়ছে।
বাংলাদেশ সময়:১২১৫ঘণ্টা, জুন ২০ ২০১৩
এমইউ/টিসি