ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিট অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে এখনও রাজনৈতিক সহিংসতায় দগ্ধদের যন্ত্রণাকাতর আহাজারি, গোঙানি। আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষগুলোর প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল এই বার্ন ইউনিট।
গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় আবারো আলোচনায় ঢামেক বার্ন ইউনিট। এর আগে তাজরীন গার্মেন্টেসে অগ্নিদগ্ধদের এবং নিমতলীর ভয়াবহতম আগুন ট্রাজেডিতে দগ্ধ রোগীদের সেবা দিয়ে ঢের প্রশংসা ও সুনাম কুড়িয়েছে বার্ন ইউনিট। তবে দুর্ঘটনা আর সহিংসতার এদেশে যখন ঘটনা ঘটে তখই নজর পড়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সেবাখাতের দিকে। অন্য সময় এর কথা মনেই থাকে না কারোরই। তাই বাড়ানো হয় নি বার্ণ ইউনিটের সুযোগ সুবিধা।
গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ জন মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরেছে এই বার্ন ইউনিটে। বর্তমানে ৩০ জন রোগী রয়েছেন যারা রাজনৈতিক সহিংসতায়, গাড়ি পোড়ানো এবং পেট্রোল বোমায়, দগ্ধ হয়ে সেবা নিচ্ছেন এখানে।
তবে পুরো বার্ন ইউনিটে রয়েছে ৩৬৪ জন রোগী। প্রতিদিনই এখানে রয়েছে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ রোগীর চাপ। নির্ধারিত শয্যাসংখ্যার চেয়ে এখানে প্রায় চার গুণ বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
বার্ন ইউনিট সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শয্যা সংকটে অনেক রোগীকেই থাকতে হচ্ছে হাসপাতালের ফ্লোরে। তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এর ফলে সংক্রমণের আশংকা যেমন বাড়ছে, রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে সমান তালে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কমপ্লেক্সের ভেতরেই ২০০৩ সালে ৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ইউনিট নিয়ে যাত্রা শুরু করে বার্ন ইউনিট। কিন্তু অবহেলায় খুঁড়ে খুঁড়ে চলছিল সেবাকেন্দ্রটি। রাজধানীর নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় টনক নড়ে সবার। পরে গত ২০০৯ সালে এসে তা ১০০ শয্যায় রূপ নেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বার্ন ইউনিটের অবকাঠামো বাড়ে নি।
বর্তমানে বার্ন ইউনিটে দায়িত্বরত ৬০ চিকিৎসকের মধ্যে ৪২ জনই শিক্ষানবিশ(ইনটার্ন)। রয়েছে সেবিকার সঙ্কট। ১৫০ জনের কাজ করার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৭০। এছাড়াও ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে অন্যসব স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
২০১২ সালে তাজরীন ট্রাজেডির পর আবারো টনক নড়ে সরকারের। সেবার দগ্ধ রোগীতে ভরে উঠেছিলো বার্ন ইউনিট। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বার্ন ইউনিটকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি’তে পরিণত করার প্রশাসনিক আদেশ জারি করে। তবে তা বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত নেয়া হয় নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ।
সরজমিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, রোগীর চাপে এখন সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শয্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি। আবার বারান্দায়ও রোগী রয়েছে।
নিয়ন্ত্রণের অভাবে দর্শনার্থীদের ভিড় যেমন রয়েছে, তেমনি বহিরাগত লোকজনও ঘোরাফেরা করছেন নিজেদের খেয়ালখুশিমতো। দগ্ধ রোগীর বিছানার পাশেই রোগীর নোংরা জিনিসপত্র রাখা রয়েছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগীকে ফ্লোরে রাখা হয়েছে।
অভিযোগের মধ্যে প্রধানগুলো হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়মিত দেখা পাওয়া যায় না। আবার রোগীর চাপ থাকায় তাড়াহুড়ো করে ড্রেসিং করানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্ন ইউনিটের একজন চিকিৎসক জানান, দর্শনার্থীদের অতিরিক্ত চাপে দগ্ধ রোগীদের সংক্রমণের ভয় থাকে। এতে সেপটিসেমিয়া হয়ে রোগীর মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দগ্ধদের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসাও দরকার। কিন্তু আমাদের এখানে সেটি সম্ভব হয় না।
ধানমণ্ডি থেকে আসা এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করে বলেন, এখানে আসার পর ভর্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এই জায়গার কর্মচারীরা অনেকের কাছে টাকা চায়। ওষুধ কেনা ও পরীক্ষা করানোর টাকা সঠিক সময়ে না পেলে রোগীকে অনেকটা চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়।
তিনি বলেন, অনেক সময় ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে শুইয়ে রাখা হয় রোগীকে। সব ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। তাই রোগীর সঙ্গে থাকতে হয় দুজনকে। আবার এখানে একজনের বেশি থাকতে দেয়া হয় না।
অনেক রোগীকে ফ্লোরে ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থায় থাকতে হয়। বেশি দগ্ধ রোগীদের দেখেও তুলনামূলকভাবে কম দগ্ধ রোগীরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এর মধ্যে বেশি দগ্ধ রোগীদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন। যাদের বার্ন (পোড়া ক্ষত) ১৯ শতাংশের বেশি তাদেরকে রাখা হয় ২ শতাংশ বার্ন রোগীদের সঙ্গেই।
তবে এত কিছুর পরেও ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা সন্তুষ্ট। এখানে তারা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন বলেই জানালেন। রোগীদের স্বজনদের কিছু কিছু অভিযোগ থাকলেও, রোগীরা প্রায় সকলেই বললেন, ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তারা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন। এত সংকটের বেড়াজালেও ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটই তাদের ভরসার স্থান।
বাংলানিউজ টিম দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে ঢামেক বার্ন ইউনিটে। রোগীদের মুখে চিকিৎসা নিয়ে প্রত্যাশা, সন্তুষ্টি আর অভিযোগ ছাপিয়ে এখন শুধুই ঘরে ও কাজে ফেরার স্বপ্ন। এ নিয়েই থাকবে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব। আর তৃতীয় পর্বে থাকবে কর্তৃপক্ষের কিছু অকপট স্বীকারোক্তি ও সেবা দিতে পারার স্বস্তির কথা। থাকবে বার্ন ইউনিট নিয়ে নতুন পরিকল্পনার কথাও।
বাংলাদেশ সময় ১২২৭ ঘন্টা; জানুয়ারি ১৫, ২০১৪
এমএন/এমএমকে/জেএম