গোদাগাড়ী (রাজশাহী): রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স সংকট প্রকট। নেই ওষুধের সরবরাহ ও জেনারেটরের ব্যবস্থা; অ্যাম্বুলেন্সটিও বিকল।
১৯৯৮ সালে নির্মিত এ হাসপাতালটি ২০০১ সালের সেবা কর্যক্রম শুরু করে। ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকার ফলে হাসপাতালে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, বাবুর্চি, সুইপার চিকিৎসকের কাজ করে চলেছেন দিনের পর দিন। যেন দেখার কেউ নেই।
স্থানীয় জনগণ ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন হাসপাতালটির বেহাল চিত্র।
হাসপাতালের পাশেই বসবাসকারী স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইলিয়াস আলী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সাংবাদিকরা আসে আর তথ্য নিয়ে যায়, কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসার কোনো উন্নতি হয় না। যে রকমেই সমস্যা সেই রকমই আছে। আর কতদিন চলতে থাকতে এমন বেহাল দশা?
গত ২০ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টায় সময় মুন্ডমালা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মেরিনা বেগমের বাবা মন্টু মিয়া এই প্রতিবেদককে জানান, দুই দিন আগে মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। রোগীর অবস্থার কোনো উন্নতি নাই। ডাক্তারের লিখে দেওয়া ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়েছে ।
বেলা সাড়ে ১১টা বেজে গেলেও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ভিজিট করেননি, তাই ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি, বলেন মন্টু মিয়া।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের ইনচার্জ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম রাজশাহী শহরের অবস্থান করায় প্রায়ই বিলম্বে অফিসে আসেন।
হাসপাতলটিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শূণ্যতা থাকায় বেশীরভাগ দিনই হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট, সুইপাররা চিকিৎসকের কাজ করেন।
গত ২০ আগস্ট সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পৌর এলাকার আমতলা গ্রামের সোহেল সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে শরীরের কয়েক জায়গায় ইনফেকশন হয়ে যায়। তিনি ওয়াশ করার জন্য আসলে জরুরি বিভাগে তাকে সুইপার রানা দাশ চিকিৎসা দেন।
জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার নিয়ম থাকলেও সেখানে রয়েছেন একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার।
হাসপাতালে কর্মরত নার্স মো. আনোয়ার হোসেন, ফর্মাসিস্ট কায়েশ আলীসহ বেশ কয়েকজন এমবিবিএস ডাক্তারের স্থলে রোগীদের চিকিৎসা দেন।
এরমধ্যে আনোয়ার হোসেন গোদাগাড়ী সদরের ডাইংপাড়া মোড়ে তার নিজের মালিকানাধীন ‘গোদাগাড়ী জেনারেল হাসপাতাল’ এ রোগীদের ভর্তির জন্য প্ররোচিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২০ আগস্ট উপজেলার রাহী গ্রাম থেকে আসা জ্বরের রোগী বিলকিস খাতুনের বিছানায় ‘গোদাগাড়ী জেনারেল হাসপাতাল’ এর খামে রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষার কাগজপত্র দেখা যায়।
রোগীরা জানান, হাসপাতালটির ইনচার্জ (টিএইচ) ডা. ফজলুল করিম নিজেই ‘গোদাগাড়ী জেনারেল হাসপাতাল’ এ রোগী দেখেন। তিনিও বিভিন্ন সময়ে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ওই ক্লিনিকে পাঠিয়ে থাকেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা য়ায়, নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালটিতে চিকিৎসক থাকার কথা ৯ জন কিন্তু আছেন ৩ জন। এদের মধ্যে আবার একজন চিকিৎসক (ডেন্টাল সার্জন) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেপুটেশনে আছেন। নার্স থাকার কথা একজন সুপারভাইজারসহ ১১ জন, কিন্তু কর্মরত আছেন ৫ জন।
এছাড়াও কর্মরত আছেন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দুইজন, আয়া ৩ জন, ওয়ার্ডবয় ২ জন, গার্ড ১ জন, মালি ১ জন, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ১ জন, জুনিয়র মেকানিক ১ জন, কুক/মশালচি ২ জন, রেডিওগ্রাফার ১ জন।
হাসপাতালটির অফিস প্রধান সহকারী মো. তৌহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ২০০১ সালে সেবা কার্যক্রম চালু হলেও এত দিনেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওষুধ বরাদ্দ থেকে শুরু করে চিকিৎসক নিয়োগ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল না থাকার কারণেই এত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় দেড়শ রোগী আসেন। তিনি এ ব্যাপারে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওষুধ বরাদ্দ না থাকায় রাজশাহী সিভিল সার্জন অফিস থেকে অল্প পরিমাণ ব্যাথা-জ্বরের ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়রিয়া রোগীদের জন্য কলেরা স্যালাইন, গর্ভবতী রোগীদের জন্য আয়রন ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
তাই হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা এতে সন্তোষ্ট নন।
হাসপাতালে শুরু থেকেই এক্স-রে মেশিন থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দীর্ঘদিন থেকে তা নষ্ট হয়ে আছে। আর প্যাথলজির ব্যবস্থা থাকলেও শুধু প্রসাব পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু করা হয় না।
হাসপাতালের রান্নাঘরে ঢুকে দেখা যায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না করা হচ্ছে। আর রান্না করা খাবার না ঢেকেই রোগীদের পরিবেশন করা হচ্ছে।
রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরাদ্দকৃত সকালের খাবার ঠিকমত পেলেও মাছ ও মাংস ঠিক মতো দেওয়া হয় না। নিয়ম অনুয়ায়ী সপ্তাহে দুই দিন রোগীদের মাংস দেওয়ার নির্দেশ থাকলেও তা করা হয় না।
গত ২০ আগস্ট রাহী গ্রামের বিলকিস বাংলানিউজকে জানান, জ্বর-মাথা ব্যাথা নিয়ে চার দিন থেকে ভর্তি আছেন। এ চার দিনের মধ্যে একদিনও খাবারে মাংস পায়নি বলে জানান।
হাসপাতালেন প্রধান অফিস সহকারী মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে সবার থাকার জন্য হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ব্যবস্থা থাকলেও ডাক্তাররা সেখানে থাকেন না।
উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের বাড়ি গোদাগাড়ীতেই। আর বিশেষজ্ঞ (এমবিবিএস) ডাক্তাররা পরিবেশগত দিক ভালো না থাকায় সেখানে থাকেন না বলে জানান।
হাসপাতালের ইনচার্জ (টিএইচ) ডা. ফজলুল করিম জানান, রাজশাহী শহরে থাকলে ডাক্তাররা পড়াশুনা করতে পারেন এবং নতুন নতুন তথ্য পেতে সুবিধা হয়। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে থাকলে সেটা তারা পান না।
হাসপাতালের সার্বিক সমস্যা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, আমি এ হাসপাতালে নতুন যোগদান করেছি। সবকিছু আমার তেমনভাবে জানা হয়নি। তাই এ ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের সেবা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কানাডা, সুইডেন, আমেরিকাসহ বাইরের বিভিন্ন দেশে সুইপার, মালী এ কাজগুলো অহরহ করে থাকে। সুইপার সেবা দিচ্ছে এটা তেমন কিছু না বলে জানান।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুস সোবহানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে অফিসের একজন স্টাফ রিসিভ করে জানান, স্যার কাজে ঢাকায় গেছেন এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করেন। তার কাছে মোবাইল নাম্বার চাওয়া হলে তিনি জানেন না বলে জানান।
** ওয়ার্ড বয় যেখানে সার্জন
বাংলাদেশ সময়: ০০২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৪