ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বেহাল দশায় স্বাস্থ্যসেবা

নিজেই রোগী ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল

আসিফ ইকবাল কাজল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৪
নিজেই রোগী ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঝিনাইদহ: উনিশ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য স্থাপিত হয়েছিল ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল। কিন্তু এখন সেটি নিজেই যেন রোগী।

ওষুধের অপ্রতুল সরবরাহ, কম শয্যাসংখ্যা ও জনবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না হাসপাতালটি।

একশ শয্যার এই হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে সাতশ থেকে প্রায় এক হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে সেখানে ভর্তি হন নব্বই থেকে একশ দশ জন।

বহির্বিভাগ ও অন্ত:বিভাগে (ইনডোর-আউটডোর) প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগীর চাপ সেই তুলনায় এখানে শয্যা নেই। বেশির ভাগ রোগীকে তাই হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিতে হয়। সেই সঙ্গে মিলছে না সব ধরনের ওষুধ। এর উপর আবার পঞ্চাশ শয্যার জনবল দিয়ে একশ শয্যার  এই হাসপাতালটি চলছে খুঁড়িয়ে।

সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ কোনো ‍চিকিৎসক না থাকায় ভর্তি হওয়া রোগীরা মাঝেমধ্যেই হাসপাতাল ছেড়ে ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন।

রোগীর চাপের কারণে অনেক সময় বাইরের হাসপাতাল থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (ডেপুটেশনে) এনে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তারপরও সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন ভর্তি হওয়া রোগীরা।

১৯৯৭ সালে হাসপাতালটি পঞ্চাশ থেকে একশ শয্যায় উন্নীত করা হয়। সে মোতাবেক রোগীর খাবার, শয্যা ও ওষুধ সরবরাহ করা হলেও সতের বছর ধরে জনবল কাঠামো রয়ে গেছে সেই পঞ্চাশ শয্যারই।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে জানা গেছে, ১৮৯০ সালের দিকে শহরের ছবিঘর সিনেমা হলের পশ্চিম দিকে ব্রিটিশ আমলে দশ শয্যার একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৭০ সালে হাসপাতালটি একত্রিশ শয্যায় উন্নীত করে ঝিনাইদহ শহরের হামদহ এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে স্থাপন করা হয়।

১৯৮৪ সালে হাসপাতালটি একত্রিশ থেকে পঞ্চাশ শয্যায় উন্নীত করা হয়। স্বাধীনতার পর চুয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালটিতে এখনো সেই পঞ্চাশ শয্যার  জনবলই রয়ে গেছে। অথচ নামে এখন এটি একশ শয্যার।

তা-ও আবার পঞ্চাশ শয্যার জন্য ২৩ জন ডাক্তারের মধ্যে সতেরো জন ডাক্তার দিয়ে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালটি চালানো হচ্ছে যেনতেন প্রকারে। ফলে পদে পদে রোগীদের দুর্ভোগ-দুর্দশা বেড়েই চলেছে।

একশ শয্যার হাসপাতাল হলেও চুয়াল্লিশ জন ডাক্তারের পদ এখনো শুন্যই রয়েছে। এর মধ্যে বছরের পর বছর চক্ষু, চর্ম, শিশু, নাক কান গলা, রেডিওলজিস্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পদ খালি রয়েছে।

অসামাল পরিস্থিতির কারণে চক্ষু চিকিৎসকের পদে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. শামিমা সুলতানাকে পদায়ন করা হয়েছে। ফলে চক্ষু চিকিৎসকের পদে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসতে পারছেন না। তাই চোখের রোগীরা প্রতিদিন চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

হরিণাকুন্ডু উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোকাররম হোসেনকে ডেপুটেশনে সদর হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে।

তিনজন অ্যানেসথেসিস্টের (রোগীকে অচেতনকারী চিকিৎসক) মধ্যে ডা. আব্দুর রহমান ও ডেপুটেশনে আসা ডা. রতন কুমার পাল দন্ত, গাইনি, অর্থোপেডিক ও সার্জারি বিভাগ সামাল দিচ্ছেন। তারপরও অনেক রোগী ফিরে যাচ্ছেন।

অ্যানেসথেসিস্ট আব্দুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, গত সাত মাসে ঝিনাইদহ হাসপাতালে দন্ত, গাইনি, অর্থোপেডিক ও সার্জারি বিভাগে চার হাজার ষাট জন রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

অ্যানেসথেসিস্টদের তিনটি পদ পূরণ করা সম্ভব হলে অপারেশনের পরিসংখ্যান আরো বাড়তো এবং রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে পারতেন বলে মনে করেন আব্দুর রহমান।

ঝিনাইদহর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার অপূর্ব কুমার সাহা বাংলানিউজকে জানান, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের প্রতিটি বেডের অনুকূলে এক লাখ তিন হাজার টাকা বরাদ্দ। সেই হিসেবে একশ বেডের জন্য বছরে এক কোটি তিন লাখ টাকার ওষুধ ও মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাওয়া যায়।

তিনি আরো জানান, ভর্তি হওয়া রোগীর জন্য বরাদ্দ করা টাকায় বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সরকারি নির্দেশনা মতে মানবিক কারণেই বিনামূল্যে পঞ্চাশ থেকে ষাট আইটেমের ওষুধ দেওয়া হয়।

তবে রোগীদের অভিযোগ, জটিল রোগের মূল্যবান ওষুধ হাসপাতালের স্টোরে থাকার পরও সেগুলো দেওয়া হয় না। প্রভাবশালী লোকজন ও হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক ও কর্মচারী সেসব ওষুধ আত্মসাৎ করে নিয়ে যান।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার অপূর্ব কুমার সাহা এ অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, কিছু প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যক্তি প্রতিদিন গ্যাস্ট্রিক, ব্যথা, বাত, প্রেসারের ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ফ্রি নেওয়ার জন্য উৎপাত করেন। তাদের জন্য চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

ভৌগোলিক কারণে গুরুত্বপুর্ণ ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে বছরে মাত্র এক কোটি তিন লাখ টাকার বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে তিনিসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

সিভিল সার্জনের হিসাব বিভাগের প্রধান আব্দুস সালাম বলেন, বছরে ৪/৫ কোটি টাকার ওষুধ বরাদ্দ করলে উনিশ লাখ মানুষের জেলা ঝিনাইদহে চিকিৎসা চাহিদা পূরণ সম্ভব বলে মনে করি।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী এলাকার বাসিন্দা মেডিসিন ওয়ার্ডের রোগী মো. রবিউল ইসলাম বাংলানিউজের কাছে হাসপাতালের চিকিৎসার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও সেবা ও নার্সদের কর্মকাণ্ড ও আচরণে নাখোশ।

তার অভিযোগ, রাতে শত ডেকেও কোনো ডাক্তার বা নার্সকে পাওয়া যায় না। তাছাড়া হাসপাতালের নিরাপত্তা খবুই নাজুক। যখন তখন রাতে ওয়ার্ডে বাইরের লোকজন প্রবেশ করে মোবাইল ও টাকা কেড়ে নিয়ে যায়।

নছির উদ্দীন নামে আরো এক রোগী অভিযোগ করেন, ওয়ার্ডে নার্সদের পরিবর্তে বয়দের দিয়ে রোগীদের ইনজেকশন দেওয়া হয়। এতে প্রায় সময়ই বিপত্তি ঘটে। তার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছিল বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার গায়েত্রী বালা বিশ্বাস বলেন, অনেক সময় এক সঙ্গে একাধিক মুমূর্ষু রোগী ভর্তি হলে এ রকমের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তখন রোগীর স্বজনদের কারণেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা বয় দিয়ে কাজ করাতে বাধ্য হই।

আব্দুর রাজ্জাক নামে এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের বাথরুম দিয়ে দুর্গন্ধ আসে। এছাড়াও রাতে কোনো বাথরুমেই বাতি জ্বলে না। প্রতি ওয়ার্ডে বিড়ালের আনাগোনায় রোগীরা অতীষ্ঠ।

রোগীদের অভিযোগ ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল এলাকায় তেমন কোনো চিকিৎসক থাকেন না। বেশিরভাগই বাইরে বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। এজন্য রাতের বেলা কোনো চিকিৎসককে রাউন্ডে পাওয়া যায় না। কিছু জুনিয়র চিকিৎসক রাতে দায়িত্ব পালন করেন। আর হাসপাতাল কম্পাউন্ডে বসবাস না করার ফলে ডাক্তারদের বেশির ভাগই সকাল ৮টায় আসতে পারেন না।

হাসপাতালের বেশির ভাগ চিকিৎসকের প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। এর মধ্যে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোকাররম হোসেন শহরের সমতা ক্লিনিকে রোগী দেখেন। এছাড়া গাইনি চিকিৎসক ডা. শামিমা সুলতানারও নিজের একটি ক্লিনিক রয়েছে।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কামাল হোসেন ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, রাশেদ আল মামুন প্রিন্স হাসপাতালে, সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. জাহিদুর রহমান আল আমিন ক্লিনিকে, সার্জারি বিশেষজ্ঞ মোজাম্মেল হক ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালে, হাড়-জোড় বিশেষজ্ঞ শাহাবুল করিম ফিরোজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ও দন্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চিত্তরঞ্জন নিজের ক্লিনিকে রোগী দেখেন।

রোগী দেখার ক্ষেত্রে তারা সরকারি কোনো নির্দেশনা মানেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন আব্দুস সালাম বলেন, বেতনের শতকরা ৪০ ভাগ হাউস রেন্ট কর্তন করার কারণে ডাক্তারদের কেউই হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকেন না। হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের উপস্থিতি ৯৮ ভাগ; আর তা  সন্তোষজনক। যারা দেরিতে আসেন তাদেরকে আমরা মৌখিক ভাবে সতর্ক করি।

তিনি বলেন, ডাক্তারদের ক্লিনিকে রোগী দেখতে নিষেধ নেই। তবে অফিস সময় বা ডিউটি ফাঁকি দিয়ে তারা প্রাইভেট প্রাকটিস করছেন কিনা সেটাই বিবেচ্য।

সিভিল সার্জন আরো বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অফিস সময়ে বা কাজ ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট প্রাকটিস করেন না।

এদিকে হাসপাতালের এক্সরে, রেডিওলজি ও প্যাথলজি বিভাগে দালালের অত্যাচারে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় দালালরা রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রাইভেট প্যাথলজি সেন্টার ও ক্লিনিকে। সেখানে নিয়ে ইচ্ছেমতো ফি আদায় করছে তারা।

তাছাড়া হাসপাতালের দুইটি এক্সরে মেশিন ও রক্ত সঞ্চালন বিভাগের বেশ কয়েকটি মেশিন নষ্ট থাকার কারণে বেশি মূল্য দিয়ে বাইরে থেকে এসব সেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের।

যদিও সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, আমি আসার আগে হাসপাতালে বিশৃংখলা ছিল। এখন নেই। এখন প্রতিদিন পেইং বেড, কেবিন ও প্যাথলজির টাকা জমা করা হচ্ছে। আগে এই টাকা কোথায় যেত তা কেউ জানে না।

তিনি হাসপাতালটিকে আড়াইশ বেডে উন্নীত করার দাবি জানিয়ে বলেন, সরকারিভাবে যে ওষুধ পাওয়া যায় তা জরুরি প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট। তবে একশ শয্যার জনবল কাঠামো পূরণ হলে হাসপাতালটি আরো ভালোভাবে চালানো যেত বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।