ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

বেহাল দশায় স্বাস্থ্যসেবা

‘কংক্রিটের মেঝেতে জীবনের জন্য গড়াগড়ি’

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪
‘কংক্রিটের মেঝেতে জীবনের জন্য গড়াগড়ি’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাজশাহী: চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা থেকে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভর্তি হন খালেকুজ্জামান। ভর্তি হওয়ার পর ২০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখেন কোনো শয্যা ফাঁকা নেই।

অগত্যা হাসপাতালের মেঝেতেই একটি কম্বল পেতে দেওয়া হয়। এতে মেঝেতেই শুয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাকে।

কেবল গোমস্তাপুরের খালেকুজ্জামান নয়, রোগ সারাতে রামেক হাসপাতালের মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজশাহী মহানগর এলাকাসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার রোগাক্রান্ত অনেক মানুষ।

রাজধানী ঢাকার পর চিকিৎসার জন্য উত্তরের সাধারণ মানুষের প্রধান ভরসাস্থল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কিন্তু বর্তমানে শয্যার সংখ্যার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি রোগীর চাপ নিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি। এতে হাসপাতালের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামাল দিতে না পারায় চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ উঠছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অনেক সময় রোগী ও তাদের স্বজনরা বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের সঙ্গে।  
৯০ একর জমির ওপর ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ। ১৯৬২ সালে বর্তমান অবকাঠামোর নির্মাণ শুরু হয়। দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সাত তলা ফাউন্ডেশনের ৫৩০ শয্যার হাসপাতাল ভবনটি তিনতলা পর্যন্ত পূর্ণতা পায় ১৯৬৫ সালে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের জন্য ২০ শয্যার বরাদ্দসহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান শয্যা সংখ্যা ৫৫০। তবে প্রতিদিন দেড় হাজারের অধিক রোগী রামেক হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ফলে ডাক্তার, নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা কর্মীদের প্রায় তিনগুণ কাজ করতে হয়।  

এর মধ্যে গত ২৬ জুলাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ও ক্যাজুয়েলটি নামে আরো দু’টি বিভাগ চালু করা হয়েছে। ৪৪ শয্যার এই দু’টি আলাদা বিভাগে আগুনে পোড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ হাসপাতালটিতে বার্ন ও ক্যাজুয়েলটি বিভাগ ছিল না। ফলে আগুনে পুড়ে আহত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা সাধারণ ওয়ার্ডেই দেওয়া হতো। পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ক্যাজুয়েলটি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো অর্থপেডিক বিভাগের আওতায় ১ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে। বর্তমানে ক্যাজুয়েলটি রোগীদের জন্য জরুরি বিভাগের পাশে ৩৫ এবং পোড়া রোগীদের হাসপাতালের উত্তর দিকে আইসিইউ ওয়ার্ডের নিচ তলায় ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত রোগী ভর্তির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন ২ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৯ জন। চিকিৎসা সেবা নিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৩ জন। ৫৫০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি হয় প্রায় সাড়ে ৬শ’ থেকে ৭শ’ জন। ৫৫০ শয্যার এ হাসপাতালে ১ হাজার ১৬৬ জন লোকবল থাকার কথা থাকলেও ১ হাজার ৩৪ জন রয়েছে।

এদিকে, ২০১৩ সালে হাসপাতালের জেনারেল, অর্থপেডিক, শিশু, ইউরোলজি, নিউরো, গাইনি, চক্ষু, নাক, কান ও গলা বিভাগ মিলিয়ে মোট ১৫ হাজার ৭৫৯টি মেজর ও মাইনর অপারেশন করা হয়েছে। ওই বছরে গড়ে প্রতিদিন ৪৩টি করে অপারেশন করা হয়েছে। হাসপাতালের অতিরিক্ত রোগীর চাপের কারণে জরুরি অপারেশনের সময়সূচিও ঠিকমতো বজায় রাখতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন এই হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, অতিরিক্ত রোগীর চাপে সব রোগীকে সমপরিমাণ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত করা যায় তাহলে নতুন লোকবল আসবে, সেই সঙ্গে হাসপাতালের বরাদ্দও বাড়বে। ফলে আরও সহজ হবে রোগীদের চিকিৎসা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন জানান, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বর্তমানে হাসপাতাল পরিচালনা করতে হচ্ছে। সক্ষমতার প্রায় তিনগুণ রোগীর সেবা কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যে কারণে অনেক সময়ই রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে হাসপাতালে বিদ্যমান অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি পাওয়া গেলে এই হাসপাতালের সক্ষমতা আরো বাড়বে বলে দাবি করেন তিনি।

হাসপাতাল পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দীন বলেন, তারা বাড়তি রোগীদের চাপ সামলাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে হাসপাতালের শয্যা এক হাজারে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাস পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে রামেক হাসপাতালটি এক হাজার শয্যায় উন্নীত হলে তখন লোকবল বাড়বে। সে সময় সেবার মান নিয়ে আর প্রশ্ন উঠবে না বলে জানান পরিচালক।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বাংলানিউজকে জানান, কিছুদিন আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছিলেন। হাসপাতালের সমস্যাগুলো তাকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইতোমধ্যে হাসপাতালে বার্ন ও ক্যাজুয়েলটি নামে দু’টি বিভাগ চালু হয়েছে। এক হাজার শয্যায় উন্নীত করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শয্যা বাড়ালে হাসপাতালের সেবার মান আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad