ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বেহাল দশায় স্বাস্থ্যসেবা

শয্যা ও জনবল সংকটে পাবনা জেনারেল হাসপাতাল

আবুল কালাম আজাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪
শয্যা ও জনবল সংকটে পাবনা জেনারেল হাসপাতাল

পাবনা: অপ্রতুল শয্যা, চিকিৎসক ও জনবল সংকটসহ নানা কারণে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে মা ও শিশুর চিকিৎসা সেবা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।



প্রসবকালীন শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার কমিয়ে আনার ফলে বাংলাদেশ আর্ন্তজাতিক পুরস্কার অর্জন করলেও গত আড়াই মাসে শুধুমাত্র পাবনা জেনারেল হাসপাতালেই ১১ জন প্রসূতি মা ও ৭১টি শিশুর মৃত্য হয়েছে।

সূত্র মতে, ১৮০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাবনা জেনারেল হাসপাতাল। এর পর প্রায় ২শ’ বছর পর ২০১১ সালে পাবনা জেনারেল হাসপাতাল সিভিল সার্জন এর প্রশাসনিক আওতামুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র প্রশাসন নিয়ে যাত্রা শুর করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাসপাতালটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মানুষের চিকিৎসা সেবার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠেনি। এখনো ১০০ শয্যার জনবল দিয়েই চলছে ২৫০ শয্যার বৃহৎ এই জেনারেল হাসপাতালটি।

হাসপাতালটিতে আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও চিকিৎসকের অভাবে রোগীদের সেবায় কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। রোগীদের এক্স-রে করার প্রয়োজন হলেই চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন বাইরে থেকে ডিজিটাল এক্স-রে করতে হবে। হাসপাতালে অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা শক্তিশালি জেনারেটরও বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর জ্বালানি ও অপারেটরের অভাবে চালানো হয় না। দীর্ঘদিন জেনারেটর ব্যবহার না হওয়ায় তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বহিরাগতদের অবাধ যাতায়াতে রোগীদের মোবাইল, টাকা, ঘড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরির ঘটনা ঘটছে অহরহ।

প্রতিদিন শিশু, গাইনিসহ বিভিন্ন বিভাগের রোগীর চাপে হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। কয়েক বছর আগে পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো নিজস্ব কোনো হাসপাতাল না হওয়ায় ২৫০ বেডের পাবনা জেনারেল হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, পাবনা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৩৬টি শয্যা রয়েছে। এই শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে ২শ’ রোগী ভর্তি হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত গত আড়াই মাসে শিশু ওয়ার্ডে ২ হাজার ৭৭৬টি শিশু ভর্তি হয় যাদের মধ্যে ৭১ জনই মারা যায়। এদের মধ্যে ৩০ জন বার্থ এক্সপিয়া, ৮ জন সেলটাসিয়া, ১০ জন সিভিয়ার নিউমোনিয়া, ১৬ জন লো-বার্থ ওয়েট ও ৭ জন মেনেনজাইটিস রোগে মারা যায়। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই শিশু মারা গেছে ১৩ জন।

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বাড়িতে প্রসব হওয়ার পর রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় এসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় সবাইকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অনেকেই মারা যান।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের শয্যা সংখ্যা ৩৬টি। এই সিটের বিপরীতে প্রতি মাসে রোগীর সংখ্যা দেড়শ’ থেকে দুইশ’। গত আড়াই মাসে গাইনি বিভাগে ২ হাজার ৭ জন মা ভর্তি হন যাদের মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়।  

পাবনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার মধুপুর গ্রামের এক শিশুর বাবা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, শয্যার চেয়ে রোগীর চাপ বেশি থাকায় ১ বেডেই ৩ থেকে ৪ জন শিশুকে রাখা হচ্ছে। এতে শিশুদের ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কখন ভুল করে নার্সরা এক রোগীর ওষুধ অন্যজনকে দিয়ে ফেলে।

তিনি আরো বলেন, শিশুদের শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত নিবোলাইজার টাকার বিনিময়ে আয়ারা দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় সঠিক পরিমাণ না দেখেই অনভিজ্ঞ আয়ারা তাড়াহুড়া করে কাজ চালিয়ে যান।

মুন্নী খাতুন নামের এক শিশুর মা জানান, এখানে সব কিছুই টাকার বিনিময়ে করতে হয়। বাথরুমে যাওয়া ১০ টাকা, বাচ্চার কাপড় চোপড় পরিস্কার করা ২০ টাকা, নিবোলাইজার দেওয়া ১০ টাকা সব মিলে দিনে ১০০ টাকার মত প্রতিটি রোগীর কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে আয়ারা হাতিয়ে নেয়। টাকা দিলে সিরিয়াল লাগে না দ্রুত কাজ হয়ে যায়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পাবনা কলেজের অধ্যাপিকা ফারজানা ইয়াসমিন জানান, হাসপাতালের বাথরুম ব্যবহারের অনুপযোগী। টয়লেটে বদনা নেই, সময়মত পানি পাওয়া যায়না। মহিলাদের জন্য কোনো আলাদা টয়লেট নেই। অনেক সময় বাথরুম করতে গিয়ে নিজেকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।

আটঘরিয়া উপজেলার পাটেশ্বর গ্রামের সুলতান মল্লিক বলেন, হাসপাতালে সেবার মান যাই হোক না কেন দালালদের অত্যাচারে সেই সেবা নেওয়াই কঠিন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নার্সরা সরাসরি দালালদের দেখিয়ে দিয়ে বলেন ওর সঙ্গে যান। তখন না গিয়ে কোনো উপায় থাকে না। রাতে আবার দায়িত্বরত আনসাররা টাকার বিনিময়ে হাসপাতালের ভেতরে লোক থাকতে দেয়।

সদর হাসপাতাল নিয়ে কথা বলতেই পাবনার প্রবীণ সাংবাদিক মাহফুজ আলম বলেন, ডাক্তারি পেশাটা অন্যসব পেশা থেকে আলাদা। এটি একটি মহৎ পেশা, কিন্তু সকাল থেকেই যখন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মোটরসাইকেলের পেছনে ডাক্তারদের ঘুরতে দেখি তখন মনে হয় সেবার চেয়ে মুনাফার দিকেই বেশি ঝুঁকছেন তারা। এটা ঠিক নয়।

কোনো রকম জোড়া তালি দিয়ে ২৫০ শয্যার পাবনা জেনারেল হাসপাতাল চলছিল। কয়েকবছর আগে পাবনা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো নিজস্ব কোন হাসপাতাল না হওয়ায় ২৫০ বেডের পাবনা জেনারেল হাসপাতালই মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

সম্প্রতি কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে রহস্যজনক কারণে বদলি করায় পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এখনো পাবনা জেনারেল হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে জুনিয়র এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট নেই, সার্জারি, কার্ডিওলোজি, গাইনি, প্যাথোলজি, রেডিওলজি বিভাগে কনসালটেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি রয়েছে।

হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহীন ফেরদৌস শানু বলেন, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকটের কারণে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার ৭০ শতাংশও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নীতিশ কুমার হাসপাতালে শিশু মৃত্যুর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বার্থ এক্সপিয়া, লো-বার্থ ওয়েটসহ নানা জটিলতায় শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে। যে সব শিশু মারা গেছে তারা সবাই হাসপাতালে জন্ম নিয়েছে এমন নয়। অনেক গর্ভবতী মাকে বাড়িতে স্থানীয় দাইয়ের কাছে প্রসবের চেষ্টা করা হয়। পরে যখন কোনো উপায় থাকে না তখনই পরিবারের লোকজন মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রসবের সময় ওই সব গর্ভবতী মা অথবা বাচ্চার মৃত্যু হয়ে থাকে।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাক্তার মনোয়ার-উল-আজীজ বলেন, হাসপাতালের দালালরা কোনো না কোনো প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকে। কাজেই এদের পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন। ২৫০ শয্যার জায়গায় দ্বিগুণ বা তিন গুণ রোগী থাকায় সরকারি বরাদ্দ এদের ভাগ করে দেওয়ায় সবাইকে খুশি করা যায়না। তবে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।

প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাবনার সচেতন মহলের দাবি, অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে জেনারেল হাসপাতালের সব সমস্যার সমাধান করে চিকিৎসা সেবায় পাবনাবাসীর দুর্ভোগ লাঘব করবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।