ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

পলিয়াটিভ কেয়ারে ধুঁকছে ঝর্ণা

ব্যথা কি একটু কমানো যায়!

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫
ব্যথা কি একটু কমানো যায়! ছবি : নাজমুল হাসান / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় ৩৫ বছরের ঝর্ণার। কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে হাসপাতালের বেডে কুঁজো হয়ে শুয়ে পড়েন।

বেশির ভাগ চুলেই পাক ধরেছে। চেহারায় ব্যথার চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
 
নিরাময়-অযোগ্য ক্যান্সার নিশ্চিত হওয়ার পর স্বামী আসমত আলী ঝর্ণাকে ছেড়ে চলে গেছেন। ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে এখন শেরপুর আর ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সেন্টার ফর পলিয়াটিভ কেয়ারে দিন কাটে তার। কখনো কখনো ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন তিনি।
 
সোমবার সকালে কথা হয় ঝর্ণার সঙ্গে। বছর তিন আগের ঘটনা। এক সময় সাদা স্রাব হতো ঝর্ণার। পরিবারের মুরুব্বি নারীদের এবং পরিবার-পরিকল্পনা কর্মীদের বিষয়টি জানালে, সবাই স্বাভাবিক হিসেবেই বিবেচনা করেন। তবে এটি মাসে অনেক সময় ধরে চললে ঝর্ণার দুঃচিন্তা বেড়ে যায়।

ঘটনাটা তিনি তার ছেলের স্কুলের এক শিক্ষিকার কাছে বলেন। শিক্ষিকা একজন গাইনি চিকিৎককে রেফার করেন। এরপরেই ধীরে ধীরে নিশ্চিত হয়, ঝর্ণার ক্যান্সারে আক্রান্তের বিষয়টি। বিভিন্ন সময় কেমো আর থেরাপি নিতে নিতে নিজের অর্থকড়ির সবটুকু নিঃশেষ করে দেন এই নারী।
 
নিজের চূড়ান্ত অবস্থার জন্য তৈরি হয়ে যান ঝর্ণা। এমন সময় বিএসএমএমইউ’র পেলিয়াটিভ কেয়ার থেকে বলে দেওয়া হয়, আপনার সব চিকিৎসা শেষ। তখন ঝর্ণা চিকিৎসকদের কাছে আকুতি করে বলেন, শরীরের ক্ষতস্থানের ব্যথা কি একটু কমানো যায়? 

ঝর্ণার মতো এ রকম অসংখ্য ক্যান্সার রোগীর ব্যথা প্রশমন থেকে বাঁচার আকুতিতে সাড়া দেওয়াই কাজ, সেন্টার ফর পলিয়াটিভ কেয়ারের।

বিএসএমএমইউ’র সেন্টার ফর পলিয়াটিভ কেয়ারের ইন-চার্জ ডা. নিজামউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, নিরাময়-অযোগ্য রোগে আক্রান্তদের আমরা বাঁচাতে পারি না। কিন্তু, পলিয়াটিভ কেয়ারের মতে, ‘কিছুই করার নেই’ একটি ভুল ও পলায়নপর মনোবৃত্তিসুলভ কথা।
 
ডা. নিজামউদ্দিন বলেন, অনেক রোগ রয়েছে, যেগুলো ভালো না হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনটাও ছোট হতে থাকে। যেমন- কিছু কিছু ক্যান্সার রয়েছে, আপনি যত চিকিৎসাই করান, যত ভালো চিকিৎসাই করান, ভালো হয় না। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বলছেন, ‘আর কিছু করার নেই’। সবাই তা মেনেও নিচ্ছেন।
 
তিনি বলেন, নাহ! কিছু না কিছু নিশ্চয়ই করার আছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা, সমাজসেবা ব্যবস্থাকে এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। এদের কষ্ট ও সমস্যা লাঘবে সচেষ্ট থাকতে হবে।
 
তিনি বলেন, পৃথিবীতে ৪৫টি দেশে পলিয়াটিভ কেয়ার রয়েছে, যা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। গত সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বিষয়টি স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্তের কথা বলেছে। এসব রোগীদের জন্য ওষুধ সরবরাহের কথা বলেছে।
 
বর্তমানে বিএসএমএমইউ’র প্যালিয়াটিভ কেয়ারে ৯ জন পুরুষ এবং ৯ জন নারী রোগী মিলে মোট ১৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এখানে রোগীরা কোন পর্যায়ে সেবা নেন, তা বোঝা যায়, এক কথাতেই- ‘আজকে দুটো বিছানা খালি আছে। কারণ, একজন গতকাল মারা গেছেন। ’
 
ডা. নিজামউদ্দিন বলেন, যখন ২০০৭ সালে বিএসএমএমইউতে এ সেবা প্রদান শুরু হয়, তখন মাত্র ১৪ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। ২০১১ সালে এই সেন্টার হলে ৮২৮ জনকে সেবা দেওয়া হয়। আর ১০১৪ সালে প্রায় ১,৪০০ রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিরাময়-অযোগ্য লোকের সংখ্যা অনেক। আমরা এখানে ছোট্ট পরিসরে যে সেবা দিই, ঢাকা শহরে তা অনেকেই জানেন না।
 
এখন ধীরে ধীরে অনেক হাসপাতালেই পলিয়াটিভ কেয়ার সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। ডা. নিজামউদ্দিন জানান, কিছুদিন আগে খুবই অল্প সংখ্যক বেড নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শুরু করেছে এ সেবা প্রদান। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটও শুরু করেছে স্বল্প পরিসরে।

তবে সরকারি সহায়তা না থাকায় এ সেবা গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
 
পলিয়াটিভ কেয়ারে সেবা নেওয়া ক্যান্সার রোগীদের সর্ম্পকে তিনি বলেন, রোগীর প্রথম সমস্যা হচ্ছে ব্যথা। বিভিন্ন স্থানে ঘায়ের ব্যথায় তারা ছটপট করেন।
 
চিকিৎসার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবী জুড়ে ক্যান্সার রোগীদের জন্য মরফিন হচ্ছে স্বীকৃত ট্যাবলেট। কিন্তু, আমাদের দেশে এই ট্যাবলেট রোগীরা পান না। মরফিন নিয়ে আমাদের এখানে মিথ্যা ধারণাও বজায় রয়েছে। চিকিৎসকেরাও এ ভ্রান্ত ধারণার শিকার এবং তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও নেই।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভ্রান্ত ধারণা ও দীর্ঘসূত্রিতা একটি সমস্যা। এ কারণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি দেওয়া ব্যথার ওষুধ মরফিন পাওয়া যায় না। এখানে ব্ল্যাকে গেলে পাবেন। এমনি পাওয়া যায় না।
 
ডা. নিজামউদ্দিন বলেন, রোগীর এত ব্যথা হয় যে, তারা অনবরত চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু এর ওষুধ নেই। এখানে হাসপাতালে পাওয়া গেলেও, রোগী যখন বাসায় যান, তখন পান না। এখানে তবু ১০ টাকার মরফিন ওষুধ ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয় ধারে-কাছের মার্কেটে।  
 
নিজামউদ্দিন বলেন, ক্যান্সার আক্রান্তের ব্যথা ছাড়াও রয়েছে, দুর্গন্ধযুক্ত ঘা, শ্বাসকষ্ট, পেটে পানি আসার মতো সমস্যা। এসব উপসর্গ কমাতে আমাদের চিকিৎসকদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়াও এসব রোগীদের রয়েছে, মানসিক ও সামাজিক কষ্টও।
 
আমাদের দেশে সাধারণত ‘পলিয়াটিভ কেয়ার’ বলতে মূলত ‘ক্যান্সার’ রোগকেই বোঝেন। আবার আফ্রিকায় পলিয়াটিভ কেয়ার হচ্ছে- এইডস রোগ।

তিনি বলেন, এটা আসলে ‘অনিরাময়-যোগ্য রোগে আক্রান্তের সেবা’। যেমন, ঢাকা শহরে কত পেসেন্ট রয়েছেন, যাদের শরীর অবশ। স্ট্রোক, যাদের হয়ত শরীরের অর্ধেক চলতে পারছে না। বৃদ্ধ বাবা-মা হাঁটাচলা করতে পারছেন না। এরাও পলিয়াটিভ কেয়ারের অন্তর্ভুক্ত।
 
তিনি বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা হচ্ছে, সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া। চিকিৎসক যে মুহূর্তে বলেন, ‘আর কিছু করার নেই, তখন কিন্তু ওই পরিবারের হাতে আর টাকা-পয়সা নেই। তখন যন্ত্রণা আর কষ্ট কমানোর জন্য যে চিকিৎসা প্রয়োজন, সেটাও পান না রোগী। তারপর এক সময় তিনি মারা যান। নিজের সংসারটাও মেরে রেখে যান।
 
বিএসএমএমইউ’র সেন্টার ফর পলিয়াটিভ কেয়ার এখন মানুষের অনুদান আর হাসাপাতালের খরচে চলছে।

ডা. নিজামউদ্দিন জানালেন, অনেকেই এখানে জাকাতের টাকা দিচ্ছেন। ধনী-গরিব সবার জন্য এ সেবা নিশ্চিত করতে হবে। সেবা মানে শুধু মাথায় হাত বোলানো নয়; সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাটাও যেন পায়।
 
তিনি আরো জানালেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র জায়গা, যেখানে বেডগুলো সম্পূর্ণ ফ্রি। আর রোটারি ক্লাব অব মেট্রোপলিটন কিছু আর্থিক সহযোগিতা দেয়। তবে আজ পর্যন্ত পয়সার অভাবে কাউকে এই সেন্টার থেকে ফেরত দেওয়া হয়নি। কারণ, তারা ইতোমধ্যে সর্বশান্ত হয়ে তারপর এখানে এসেছেন।
 
পলিয়াটিভ কেয়ার বিষয়টিকে স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করলে সরকারের খরচ বাড়বে না বলে মনে করেন ডা. নিজাম। তিনি বলেন, খুব কম অর্থে, কম রিসোর্সে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এটাকে বলে ‘লো টেকনোলজি, হাই টাচ’। এ সবের ওষুধের দামও কম। সরকার আরো কমাতে পারে ওষুধের দাম, বলেন নিজামউদ্দিন।
 
এদিকে, হোম কেয়ারে সেবা দেওয়া হয় পলিয়াটিভ কেয়ার থেকে। ডা. নিজামউদ্দিন বলেন, আমরা রোগীকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কী চান? তারা হয়ত উত্তর দেন, মরতে চাই না। এরপর জানতে চাওয়া হয়, যদি মরতে হয়, কোথায় মরবেন? সবার শেষ ইচ্ছা- বাসায়। শেষ কথা, যদি বাসায় মরতে চান, তাহলে ঘায়ের ড্রেসিং কে করবেন? পরিবার কতটুকু করবে বা পারবে!

এরপর সেখানে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রোগীর বাসায় যাবে, এটাই হচ্ছে, পলিয়াটিভ হোম কেয়ার। এখনকার পরিবারগুলো আগের মতো নেই যে, একজন রোগী বড় পরিবারে সেবা পাবেন।
 
তিনি বলেন, এখন একজন রোগীর শারীরিক কষ্ট ছাড়াও, মনের যে কষ্ট, আত্মার যে কষ্ট, সেগুলো কে দেখবে! রয়েছে, আধ্যাত্মিক কষ্টও। এছাড়াও তার স্ত্রী-বাচ্চাকে নিয়ে কষ্ট। নিজের চাকরিটা নেই, চলবে কী করে- এ সব কষ্ট।

এ কারণে বলা হয়, পলিয়াটিভ কেয়ারে চিকিৎসার সঙ্গে পুরো সমাজকে সম্পৃক্ত হতে।

** চিকিৎসা সেবা-সমাজবিজ্ঞানে নতুন ধারণা
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।