ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্য সেবা

সাজ্জাদুর রহমান,ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্য সেবা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লক্ষ্মীপুর: উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে পিছিয়ে পড়া উপজেলা কমলনগর।

এ জনপদের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভাব আর অসুখ তাদের পিছু ছাড়ে না। তবুও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে তাদের অবিরাম চেষ্টা।

এমন অসহায় প্রান্তিক জনগণের প্রাপ্য সেবা ও স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের পক্ষে কাজ করছে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)। সহযোগীতা করছে শিশু ও নারী উন্নয়ন সংস্থা (সিডব্লিউডিএ)।

সুপ্র সামাজিক নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবার কাজ করে থাকে। সামাজিক নিরীক্ষা একটি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। যার মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকে। এর মাধ্যমে সরকারি সেবার পর্যাপ্ততা, সেবার মান ও দুর্বলতা এবং সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে জনগণের সমন্বিত মতামত জানা যায়। এতে উঠে আসে তৃণমূলের মানুষের চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা।

এভাবে সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত ও সুপারিশ তৈরি করা হয়। প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা এবং জনমত সৃষ্টি করে। এবং সরকারি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বঞ্চিতদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে চায়। সে লক্ষ্যে সুপারিশ পাঠায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে।

এরই ধারাবাহিকতায় সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, তোরাবগঞ্জ কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক ও ইসলামগঞ্জ কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক নিয়ে কাজ করছে।

সুপ্রের নিরীক্ষা কার্যক্রমে মাধ্যমে জানা যায়, কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নিত হয়েছে। ৩১ শয্যার না থাকা লোকবলই দিয়েই চলছে ৫০ শয্যার কার্যক্রম। জনবল সংকট প্রকট। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য এখানে নেই কোনো পদ। ২৪ জন নার্সের স্থলে রয়েছেন মাত্র ২জন, কনসালটেন্টদের সবগুলো পদই শূন্য।

এক্স-রে মেশিন রয়েছে, কিন্তু নেই টেকনিশিয়ান। প্যাথলজি বিভাগ চলে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে। আল্ট্রাসনোগ্রাম করার নেই ব্যবস্থা। ময়লা আবর্জনা পরিস্কার না হওয়ায় রোগীর সঙ্গে আসা সুস্থ্য স্বজনরাও হয়ে পড়েন অসুস্থ্য। ভর্তি রোগীদের বিনামূল্যে তিন বেলা খাবার সরবরাহে অনিয়ম। লোডশেডিংয়ে বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

সুপ্রে মনে করে কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিটি পর্যায়ের সেবার মান উপরিকাঠামোর দুর্বলতার জন্য বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জনগণ সেবা এবং সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত নয় এবং সেবা প্রত্যাশিতদের সেবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়ার কোনো প্রক্রিয়া নেই। বাজেট স্বল্পতা বড় প্রতিবন্ধকতা। মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল। অর্থাৎ এখানে স্বাস্থ্য সেবায় যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। তাই এসব চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ তৈরি করে সংগঠনটি।

কমলনগর উপজেলার চর ফলকন মেঘনা উপকূলীয় একটি ইউনিয়ন। মেঘনাপাড়ের দরিদ্র ও অসহায়রা সেবা পেতে  ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু এতে পর্যাপ্ত সেবা দেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেই। জনবল সংকট, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অভাব, নেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। যন্ত্রপাতি, ওষুধ, চিকিৎসা উপকরণসহ বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের অভাবে সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা বেশি প্রয়োজন। কারণ গ্রামঅঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বিঞ্চিত। তারা আর্থিক এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার কারণে শহরে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে না। তাই এ পর্যায়ে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দে ইউয়িন পর্যায়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কাজ করছে। সুপ্রে’র নিরীক্ষায় তোরাবগঞ্জ কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক ও ইসলামগঞ্জ কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সেবাসহ নানা দিক উঠে এসেছে। এ দু’টি ক্লিনিকে বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতির অভাব রয়েছে। ব্যবস্থাপনা কমিটির নিয়মিত সভা কার্যকর নেই।

সেবা গ্রহীতাদের কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কে আস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়নে জোরালো পদক্ষেপ নেই। যে কারণে তৃণমূলের দরিদ্র মানুষগুলো সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। এ সবই নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।

এভাবেই প্রান্তিক জনগণের প্রাপ্য সেবা ও স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে সমস্যা চিহ্নিত ও সুপারিশ তৈরি করেছে এ সংগঠনটি।

কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সরকারি চারটি সেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর সামাজিক নিরীক্ষা করেছে সুপ্র। তারই আলোকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির প্রত্যাশা পূরণে সুপারিশ তুলে ধরা হলো-

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্ধারিত বেড অনুযায়ী জনবল, ডাক্তার নিয়োগ, প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ, পর্যাপ্ত হুইল চেয়ার ও ট্রলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা। বিকল্প বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবস্থা এবং পরীক্ষা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা।

রোগীর কাছ থেকে অনাকাঙ্খিত অর্থ আদায় ও দালালদের অনুপ্রবেশ এবং ওষুধ কোম্পানীর বিপনণ কর্মীদের হাসপাতাল আঙ্গিনায় নিষিদ্ধ করা। বিনামূল্যে সব ধরনের ওষুধ দেওয়া। ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করা। হাসপাতালে সরবরাহকৃত রোগীদের খাবারের মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা। বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। স্ব স্ব উদ্যোগে অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা। সেবা বিষয়ে জনসচেতনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পরিচ্ছন্ন কর্মী ও নৈশপ্রহরী নিয়োগ করা। এবং জনবল নিয়োগে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা।

প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে এবং সরকারি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হলে সেবা বঞ্চিতদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হবে। এমনটিই প্রত্যাশা করছে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং শিশু ও নারী উন্নয়ন সংস্থার (সিডব্লিউডিএ)  নির্বাহী পরিচালক পারভিন হালিম বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তৃণমূলের মানুষ যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা পায় না।

জবাবদিহিতার অভাবে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে। যে কারণে সুপ্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জনগণের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে থাকে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরাজমান সীমাবদ্ধতা চিহ্নত করে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ম দক্ষতা ও কর্মমান নিরূপণ করে থাকে এতে করে দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের পথ সুগম হয়।

স্বাস্থ্যসেবায় মানোন্নয়ন এবং বঞ্চিত ও দরিদ্র জনগণ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে কিনা, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা  বিরাজ করছে এবং সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাবৃদ্ধির উপায় খোঁজা এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি কার্যকর ও দরিদ্রবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে সুপ্র স্বাস্থ্য সেবায় লক্ষ্মীপুরসহ ১২ জেলায় সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা করছে।

সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং দরিদ্র বিঞ্চত জনগণের জনসেবার মান বৃদ্ধি ও দরিদ্রবান্ধব সেবা প্রতিষ্ঠানের উন্নীতকরণে নীতি কৌশল প্রণয়নে সুপারিশমালা তৈরি এবং যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ ও প্রচারাভিযানের লক্ষ্যে সামাজিক নিরীক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৫

** সেবা সম্পর্কে ধারণা নেই সাধারণ মানুষের

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।