ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

‘দেশে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের কনসেপ্টই সঠিক নয়’

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৭ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
‘দেশে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের কনসেপ্টই সঠিক নয়’

ময়মনসিংহ: দেশে অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ নিয়ন্ত্রণের কনসেপ্ট বাস্তবসম্মত নয়। আর এ কারণেই প্রতি বছরই অ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা দিচ্ছে।

অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিছু কর্মকান্ড থাকলেও এ রোগ নির্মূলের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী কোন পদেক্ষপ নেই।

বৃহস্পতিবার (১৯ মে) সকালে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে অ্যানথ্রাক্স রোগ নিয়ে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.কে.এইচ.এম.নাজমুল হুসাইন নাজির।

তিনি বলেন, গবাদি পশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে কারো ন্যূনতম মাথাব্যাথা নেই। অথচ মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু মানুষে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধুমাত্র পশুতে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ঠ।

গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করলেই মানুষ আর আক্রান্ত হবে না। সবাইকে বুঝতে হবে এ রোগ গবাদিপশু থেকেই মানুষের শরীরে ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্স মানুষ বা মাটি থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায় না।

অ্যানথ্রাক্স নির্মূলের জন্য সব গবাদিপশুকে বাধ্যতামূলক বর্ষা মৌসুমের আগেই ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। পশুতে ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশে চাহিদার মাত্র সাড়ে চার ভাগ ভ্যাকসিন উৎপাদিত হয় যা নিতান্তই অপ্রতুল।

প্রায় ৫ বছর অ্যানথ্রাক্স নিয়ে গবেষণা করা ড.কে.এইচ.এম.নাজমুল হুসাইন নাজিরের অভিজ্ঞতা এমনই।

সিরাজগঞ্জের তিন উপজেলায় প্রায় ৯০ জন নারী-পুরুষ ও শিশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ায় এ রোগ নিয়ে নতুন করে উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজ। আলাপচারিতায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হবার কারণ, করণীয়, নির্মূলের উপায় এসব বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন এ বিশেষজ্ঞ।

দেশের দুর্গম এলাকায় অ্যানথ্রাক্সকে বলা হয় ‘ধাস’। দেশের ‘ডেইরি জোন’ হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বছরের এ সময়টাতে অ্যানথ্রাক্স এর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। কেন এমন হচ্ছে জানতে চাইলে দেশের কৃষি শিক্ষার মিছিলে নেতৃত্বদানকারী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সিরাজগঞ্জে নিজেদের জরিপের উদাহরণ টেনে আনেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের করা এক জরিপে দেখা গেছে, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার প্রায় ৫৭ ভাগ মানুষ জানে না অ্যানথ্রাক্স কী? আর ৯০ ভাগের ও বেশি মানুষ জানে না অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরুর মাংস খেয়ে, মাংস কাটা এবং আক্রান্ত মৃত পশুর সংস্পর্শে আসায় নিজেরাই অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে।

অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশু ১০ ফিট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, গরু থেকে অ্যানথ্রাক্স মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, যখন একটি গরু ঘাস খায় তখন ঘাসের সঙ্গে কিছু মাটিও খায়। সেখানে প্রতি গ্রাম মাটিতেই অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু রয়েছে। ফলে সহজেই গরুতে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ে।

সিরজগঞ্জের উদাহরণ তুলে ধরে ড. হুসাইন নাজির বলেন, ‘প্রায় এক মাস আগে সিরাজগঞ্জে ২৫টি গরু মারা যায়। মারা যাওয়া মাত্র ৩ থেকে ৪ টি গরু মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। কিস্তু বাকী মৃত গরুগুলোকে খোলা মাঠে ফেলে রাখা হয়। এতে করে ওই মাটিতে রোগের জীবাণুর স্পোর থেকে যায়। যা থেকে পরবর্তীতে গরু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হবে।

অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরুর লক্ষণ কী, জানতে চাইলে এ সহযোগী অধ্যাপক বলেন,‘অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরু মাঠে ঘাস খাওয়ার সময় হঠাৎ করেই পড়ে মারা যাবে, অথবা সকালে গোয়ালে গরুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাবে।

অনেক ক্ষেত্রে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু মারা যাওয়ার আগে গরু দ্রুত জবাই করে এবং কম দামে মাংস বিক্রি করে দেয়। কারণ তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে চায় না। অথচ না বুঝে তারা নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করছে। ’

গবাদিপশু থেকে মানুষের চামড়া, ফুসফুস ও নাড়িভুড়িতে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়। তবে এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সাধারণত মানুষের চামড়ায় অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়। আর এতে মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহে চিকিৎসা নিলেই অ্যানথ্রাক্স থেকে নিরাময় সম্ভব। এ রোগে আক্রান্ত মানুষকে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। সিপ্রোফোক্সাসিন ট্যাবলেট (১০ মিলি গ্রাম) ১২ ঘণ্টা পর পর টানা ৭ দিন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে। ’

পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলনের মতো অ্যানথ্রাক্স সচেতনতা বৃদ্ধিতেও আন্দোলন গড়তে হবে, এমনই মত দেন এই বিশেষজ্ঞ। তার ভাষ্যমতে, গণমাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাতে হবে।

অ্যানথ্রাক্স নির্মূলের উপায় প্রসঙ্গে ড.কে.এইচ.এম.নাজমুল হুসাইন নাজির বলেন, অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাকসিনের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সরকারিভাবে এ ভ্যাকসিনের দাম পশু প্রতি মাত্র ৫০ পয়সা। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই প্রতিটি গরুকে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন দিতে হবে। তবেই গবাদি পশুর অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

বাংলাদেশ সময় ১৭৪৪ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
এমএএএম/জিসিপি/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।