মনপুরা থেকে ফিরে: দেশের দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলার আরও দক্ষিণে পানিপথে পাঁচ ঘণ্টার দূরত্বে মেঘনার অববাহিকার উপজেলা মনপুরা। এই দ্বীপ উপজেলাতে পদায়নকে শাস্তি হিসেবেই বিবেচনা করেন সরকারি কর্মকর্তারা।
সেই দ্বীপেই স্বাস্থ্যসেবার মডেল গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মাহমুদুর রশিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি।
মনপুরা যে চিকিৎসকদের জন্য সুবিধাজনক স্থান নয়, সেটা ইউএইচএফপিও’দের বদলির তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। ২০০৮ সালে এই উপজেলায় আটজন ইউএইচএফপিও বদলি হয়েছেন, ২০১৫ সালে হয়েছেন চারজন। মাত্র তিনদিন অফিস করেই মনপুরা ত্যাগ করেছেন এমন চিকিৎসকও রয়েছেন এ তালিকায়।
সোয়া লাখ জনসংখ্যার এ দ্বীপ উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠান বলতে শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়া আর কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক নেই। যেসব উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোতেও নেই চিকিৎসক, নার্স। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১ জন চিকিৎসকের জায়গায় কর্মরত রয়েছেন তিনজন, নার্সের সংখ্যা দুই। নেই কোনো প্যাথলজিক্যাল সুবিধা। আর যেসব দ্বীপ ইউনিয়ন রয়েছে সেগুলোর সঙ্গেও নেই ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ডা. মাহমুদুর রশিদ খ্যাপাটে স্বভাবের চিকিৎসক। মনপুরার অাগে লালমোহন উপজেলায় দায়িত্বকালীন নিজের শরীরের দু’পাশে ‘হাসপাতাল পরিষ্কার রাখুন’ লেখা টাঙিয়ে রাখতেন। ডিউটি শেষে নিজের হাতে বাথরুম ও ওয়ার্ডও পরিষ্কার করতেন তিনি। পদোন্নতি পেয়ে মনপুরায় বদলি হওয়ার পর এখানকার হাসপাতালের পরিবেশ উন্নতিতে মনোনিবেশ করেন সবার আগে। যেখানে আগে চিকিৎসা নিতে রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো, সেখানে সরকারি নিয়মানুযায়ী ৩১ শয্যার এ হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসাসেবা ফিরিয়ে আনেন তিনি।
ডা. মাহমুদুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, এরপরও মানুষ আসতো না। তাই বাজারে, চায়ের দোকানে আমি নিজে গিয়ে মানুষকে হাসপাতালে আসার অনুরোধ জানাই। বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নিজে জারি গান লিখি, নিজে সুর দেই, স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে সেই গান গাই, উপজেলাবাসীকে হাসপাতালে আসার অনুরোধ জানাই।
একদিন মনপুরা উপজেলায় একজন প্রসূতিরও মৃত্যু হবে না, সেই স্বপ্ন দেখেন মাহমুদুর রশিদ।
সরকারি জনবল না থাকলেও স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কমিউনিটি ফান্ডিং সংগ্রহের মাধ্যমে চিকিৎসক রেখে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা ভেবেছেন তিনি। তার এ উদ্যোগের সঙ্গী হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান শেলিনা আক্তারসহ সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় আইসিডিডিআর,বি’র শেয়ার প্রকল্প স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কার্যকর তথ্য-উপাত্তভিত্তিক স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের নিয়ে ‘স্বাস্থ্য গবেষণা, স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও জেলা স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা সুসংহত করা’ সংক্রান্ত বিভিন্ন সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে শেয়ার প্রকল্প।
এরই ধারাবাহিকতায় ডা. এমদাদুল হক আর ডা. মাহমুদুর রশিদের মতো উদ্যমী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের পাশে দাঁড়িয়েছে আইসিডিডিআর,বি।
এর আগে যশোরের চৌগাছা উপজেলায় এমনই একজন খ্যাপাটে চিকিৎসক ডা. এমদাদুল হক বদলে দিয়েছিলেন উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা। গড়ে তুলেছেন স্বাস্থ্যসেবার ‘চৌগাছা মডেল’। ‘চৌগাছা মডেল’ এর আলোকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালকে গড়ে তুলেছেন স্থানীয় সহযোগিতায়, যেখানে স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে এমদাদুল হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার জনগণ।
আইসিডিডিআর,বি এই ভালো দৃষ্টান্তগুলোকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরে উপযুক্ত স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে।
এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বি’র বৈজ্ঞানিক ও শেয়ার প্রকল্পের পরিচালক ড. ইকবাল আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশে উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের উদ্যোগ ও নেতৃত্ব। এ লক্ষ্যে আইসডিডিআর'বি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যশোরের চৌগাছা উপজেলার স্বাস্থ্য মডেলের আলোকে মনপুরার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় কিনা সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সুপারিশমালা তৈরির কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আইসিডিডিআর,বি।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৬
এমএন/এএ