ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মাথাব্যথার নাম ওয়ানস্টপ সার্ভিস! 

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৮ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৮
মাথাব্যথার নাম ওয়ানস্টপ সার্ভিস!  ওয়ানস্টপ সার্ভিস। ছবি: অনিক খান

ময়মনসিংহ: অপারেশনের জন্য রোগীকে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে না হাজার হাজার টাকার ওষুধ, সরকারি হাসপাতালেই পাওয়া যাচ্ছে তা। হাসপাতালে এসে রোগীরা শিকার হচ্ছেন না দালালের, কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে তাদের চালান করে দিচ্ছেন না কেউ। হাসপাতালের খাবার নিয়ে রোগীদের নাক-সিটকানো ভাব দূর করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। রোগীরা পেটভরে খাচ্ছেন সপ্তাহে সাতদিনই, এমনকি অন্তত দু’দিন তাদের দেওয়া হচ্ছে খাসির মাংস ও পোলাও। 

এসব অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ। নিজের শক্তি, সাহস, সততা ও মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে তিনি এতোগুলো সেবাবান্ধব কার্যক্রম চালুর চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছিলেন প্রায় আড়াই বছর আগে।

একটা চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের পর হাত দিয়েছেন পরবর্তী চ্যালেঞ্জে।

নতুন আইডিয়া, নতুন কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এ পরিচালক মাস সাতেক আগে হাত দিলেন ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ মিশনে।  

জরুরি স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আর বাইরে ছুটতে হবে না রোগীদের। এক ছাদের নিচেই দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মিলবে সবরকম জরুরি স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবার সুযোগ। আর এ উদ্যোগের কারণে উঠে যায় হাসপাতালের ঠিক সামনেই জঞ্জালের মতো গড়ে ওঠা শত শত ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার।  

জানা যায়, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পেরে সন্তুষ্ট রোগীরা। কিন্তু এর কারণে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন অনিয়ম ও লুটপাটের নেতৃত্বে থাকা একটি সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তাদের মূল মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে এ ওয়ানস্টপ সার্ভিস।  

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সুনামকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যখন দেশজুড়েই প্রশংসিত হচ্ছেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ওয়ানস্টপ সার্ভিস, তখনই বিভিন্ন কৌশলে এই সেবাকে ঘায়েল করতে ওঠে পড়ে লাগলেন ক্ষমতাসীন দলের এক চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা, হাসপাতাল ও কলেজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কিছু চিকিৎসক এবং তাদের ঘনিষ্ঠরা।  

হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, চিকিৎসাসেবা নিয়ে রোগীদের কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু ওই মহলটির অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের ফলে এ মহৎ উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা চাইছে পরিচালকের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নষ্ট করে তাকে সরিয়ে দিতে।  

জনস্বার্থেই রোগী ও চিকিৎসক-বান্ধব এ পরিচালকের বদলি আন্দোলন করে ঠেকায় ময়মনসিংহবাসী। এমন বিকৃত অপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা বন্ধ না হলে প্রয়োজনে নাগরিকদের সঙ্গে হাসপাতালের সব কর্মচারীরাও রাস্তায় নামবে বলে জানান কর্মচারী সমিতির এ নেতা।  

হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখার একটি সূত্র জানায়, সরকার নির্ধারিত ইউজার ফির সঙ্গে ১০ পার্সেন্ট হারে সার্ভিস চার্জ নিয়ে চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ৫ হাজার ৮২৩ টাকা।  

এই টাকা থেকেই ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি আলন্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন, ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে চারটি ফ্ল্যাটপ্যানেল ডিটেক্টর, ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে চারটি বায়োকেমিক্যাল এনালাইজার, ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে কার্ডিওলজি ওয়ার্ডের এসিসহ আরও কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনা হয়েছে।  

রসিদের মাধ্যমে আদায় করা এ টাকা দিয়েই হাসপাতালের যন্ত্রপাতি তাৎক্ষণিক মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, ওয়ানস্টপে নিয়োগ দেওয়া বাড়তি চিকিৎসক ও আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া ১৪০ জন কর্মচারীর বেতন পরিশোধসহ জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় খরচ করা হচ্ছে এবং ইউজার ফি সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হচ্ছে।  

একই সূত্র জানায়, আশাতীত সেবার মানের কারণে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর, গাজীপুর থেকেও রোগীরা এ হাসপাতালে ভিড় করছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ।  ছবি: অনিক খান

২০১৫ সালে এ হাসপাতালে গড়ে ১৩০০ থেকে ১৫০০ জন রোগী ভর্তি থাকতেন। এখন প্রায় ২৫০০ থেকে ২৭০০ রোগী নিয়মিত ভর্তি থাকছেন। তাছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার রোগী সেবা নিচ্ছেন। জরুরি বিভাগের ওয়ানস্টপে আসছেন প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী।  

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও বলছে, পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন এখানে যোগ দেওয়ার আগে ২০১২-১৩ সালে এ হাসপাতালের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৩ কোটি টাকা। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৪-১৫ সালে ৪ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ সালে ৬ কোটি টাকা ও  ২০১৬-১৭ সালে ৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে ১২ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।  

ষড়যন্ত্রের বিষয়ে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ অকপটে বাংলানিউজকে বলেন, এ হাসপাতালে নতুন নতুন অনেক যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। শতভাগ ওষুধ সুবিধা, নামমাত্র ফি’তে সব ধরনের পরীক্ষা, অপারেশনের সুবিধা ও খাবারের মান ভালো হওয়ায় হাসপাতালমুখী হয়েছে রোগীরা। এতে কাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে তা সবারই জানা।  

তিনি বলেন, শিগগিরই করোনারি কেয়ার ইউনিট-সিসিইউতে ক্যাথল্যাব, কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস মেশিন, রেডিওলজি বিভাগে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই মেশিন আসছে। ফলে স্বার্থান্বেষী একটি মহল নানা রকম চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি ময়মনসিংহবাসী নিজেদের প্রয়োজনে সময়মতো এসব ষড়যন্ত্রকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দেবেন।  

জানা যায়, সব সময় চ্যালেঞ্জ নিতেই ভালোবাসেন জনদরদী এ সেনা কর্মকর্তা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তার হাত ধরেই খাগড়াছড়ি বালিয়াপাড়া বিজিবি হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা বিজিবি জেনারেল হাসপাতাল, ঠাকুরগাঁও বিজিবি হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়।  

পরবর্তী সময়ে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের কমাডেন্ট হিসেবে এ হাসপাতালকেও বিশ্বমানে নিয়ে যান তিনি। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ‘ওয়ানস্টপ মডেল’ দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চালুর নির্দেশও দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৮ 
এমএএএম/এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।