ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মনিটরিং বাড়ায় ঝুঁকি কমছে ডেঙ্গুর

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৯
মনিটরিং বাড়ায় ঝুঁকি কমছে ডেঙ্গুর

ঢাকা: এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর রোগে আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা বাড়লেও মূলত সরকারের মনিটরিংয়ের কারণেই জনগণের সামনে বিষয়টি বেশি করে উপস্থাপিত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আগেও প্রায় এ সংখ্যক মানুষই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতো। কিন্তু পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবে সেভাবে তা সামনে উঠে আসেনি। সরকারের জোর প্রচেষ্টার কারণেই এবার তা দেখা যাচ্ছে। ফলে ঝুঁকি কমছে এ রোগের। তবে এক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তনও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিকভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। ফলে সারা বছরই মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে।

এতে ঘরের আশপাশে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকার সুযোগ বেশি হচ্ছে। আর এর থেকেই বংশ বিস্তার হচ্ছে এডিস মশার। ফলে বেড়েছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ।  

তারা আরও বলেন, মূলত বর্ষার মৌসুমে যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখনই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ে। অর্থাৎ জুন মাস থেকে বেশি সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বছর সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের মনিটরিং ব্যাপকভাবে জোরদার করা হয়েছে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে অন্যান্যবারের চেয়ে এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে ডেঙ্গু জ্বরের হার এর কাছাকাছিই থাকে। এবার বেড়েছে, তবে সেটা উল্লেখযোগ্য হারে নয়। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

এদিকে ডেঙ্গু জ্বরে বা যে কোনো জ্বরে আক্রান্ত হলে দেশের মানুষজন প্রথমেই অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছে। ফলে মানবদেহে রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে এসব ওষুধ। এ কারণে রোগমুক্তি থেকে যেমন দূরত্ব বাড়ছে, তেমনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় রোগে আক্রান্তের হারও বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর ওষুধের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, ব্যাপকহারে জ্বরের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই জ্বর হলে মানুষ দোকানদারদের পরামর্শ অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে নিয়ে খাচ্ছে। তাছাড়া ওষুধ কোম্পানীগুলোর প্রতিনিধিদের সূত্রে জানা যায়, সাধারণত বর্ষাকালে জ্বর-ঠাণ্ডা জনিত রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলোর বিক্রি বাড়ে। এ বছরও বিক্রির হার অন্যান্য বছরের মতোই আছে।

আইইডিসিআরের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এবং কো-অর্ডিনেটর ডা. এএসএম আলমগীর বাংলানিউজকে জানান, বর্ষাকালে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের পানি ও ভাইরাস বাহিত রোগে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যেখানে জ্বর, সর্দি, ঠাণ্ডা, কাশি খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ সেবনটা মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয়। ভাইরাস জ্বর কিংবা ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধ নেই। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে বিশ্রাম ও মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকা।

‘তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে তখন রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণে আলাদাভাবে রক্তের প্রয়োজন হয়। আবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনুসারে একেকজন মানুষের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর লক্ষণ একেক রকম হয়। অনেকের গায়ে ব্যথা, র‌্যাশ ওঠা কিংবা বমিভাব দেখা যায়। আবার অনেকের শুধু জ্বর-ই থাকে। যার কারণে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ছাড়াই ওষুধ খেয়ে নেয়। ’

তিনি বলেন, যেহেতু এ সময়টা ‘ডেঙ্গুর সিজন’ হিসেবে পরিগণিত হয়, সেহেতু জ্বরকে একেবারেই অবহেলা করা যাবে না। ৪ দিনের বেশি জ্বর হলেই ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে বাড়ির পাশের যে কোনো এমবিবিএস ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। যখন একটা ভাইরাস বহনকারী ডেঙ্গু মশা একজন ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ভাইরাসটা মশার লালার মাধ্যমে শরীরের চামড়ার মধ্যে প্রবেশ করে। এটি রক্তের শ্বেতকণিকাতে প্রবেশ করে, কোষের ভেতর প্রজনন করে এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই মূলত জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই ওষুধ খেতে হবে।

এছাড়া এক্ষেত্রে তিনি ২০১৮ সালে সংশোধনকৃত ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুসরণ করার আহ্বান জানান। যা চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্য আবশ্যক। গাইডলাইন ২ টির লিংক হলো-

http://www.dghs.gov.bd/images/docs/Guideline/NationalGuidelineforDengue2018.pdf

http://www.dghs.gov.bd/images/docs/Guideline/Chikungunya%20Guideline%202017.pdf

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট মূলত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের সরবরাহকৃত তথ্য অনুসারে রোগীদের জরিপ করে থাকে। পূর্বে স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো এসব তথ্য সরবরাহ করতো না। বর্তমানে সরকারের চাপে সবাই এই তথ্য সরবরাহ করে থাকে।  

সে অনুসারে, ১ জানুয়ারি থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ২৫৬ জন। এদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে মাসে ১৯৩, জুনে ১ হাজার ৭৫০ এবং ৯ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ১৮২ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে এপ্রিলে ২ ও জুলাইয়ে ১ জনের মৃত্যু হয়। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৬৩৩ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে আরও জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১৬। ভর্তি মোট রোগীর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ১০ জন, মিটফোর্ডে পাঁচজন, শিশু হাসপাতালে একজন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৯ জন, হলি ফ্যামিলিতে ১৭ জন, বিজিবি হাসপাতালে পাঁচজন এবং অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৯ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে মালয়েশিয়াতে ডেঙ্গু জ্বরে ৪৬ হাজার জন আক্রান্ত ও ৭৪ জনের মৃত্যু, ফিলিপাইনে ৭২ হাজার জন আক্রান্ত ও ৩০৩ জনের মৃত্যু, সিঙ্গাপুরে ৩ হাজার ২৩৩ জন আক্রান্ত, ভিয়েতনামে ৬০ হাজার মানুষ আক্রান্ত ও চারজনের মৃত্যু, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৬ হাজার ৮০৭ জন আক্রান্ত ও ৭ জনের মৃত্যু, মিয়ানমারে ৪ হাজার জন আক্রান্ত ও ১৪ জনের মৃত্যু এবং থাইল্যান্ডে ২৬ হাজার জন আক্রান্ত ও ৪১ জনের মৃত্যু হয়। সে অনুসারে ভালো অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ।  

জ্বর হলেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর দুই হাজার ৬২৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং তাদের বেশিরভাগই রিলিজও পেয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৫৫১ জন। এর মধ্যে গত ৫ জুলাই ৯৮ জন, ৬ জুলাই ১৬৪ জন, ৭ জুলাই ১২৪ জন, ৮ জুলাই ১৩০ জন এবং ৯ জুলাই ১২৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।

সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, জ্বর হলে আমরা অনেক সময় এটি সাধারণ জ্বর মনে করি। ডেঙ্গু জ্বরও রোগীর কাছে সাধারণ জ্বর-ই মনে হবে। তাই কোনো ধরনের জ্বরকেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৯
এমএএম/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।