শুধু এই একটি ঘটনাই নয়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এমন আরও বহু অভিযোগ রয়েছে বলেই বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করেছেন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
কলেজের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তার বিরুদ্ধাচারণ করলেই শিক্ষকদের বদলি করাসহ নানাভাবে অপদস্থ করা হয়। আর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করতেও পিছপা হন না তিনি। এছাড়া বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, পছন্দের লোকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মতো অভিযোগ তো রয়েছেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেডিক্যাল কলেজের এমএলএসএস মো. ফরিদুল ইসলাম ১৯৯৯ সালে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এখানে নিয়োগ পান। স্থানীয়দের শত্রুতার কারণে ২০০৩ সালে তাকে একটি মামলার আসামি করা হয়। সরকারি কর্মচারী হয়েও ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় ওই সময় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় পরে মামলা থেকে অব্যাহতি পেলে তিনি চাকরি নিয়মিতকরণসহ বকেয়া বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. ইতেশামুল হক দুলাল সাময়িক বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহারসহ বরখাস্তকালীন ওই সময়টুকু কর্মকাল হিসেবে গণ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অধ্যক্ষকে চিঠি দেন।
এরপরের দিন অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর ফরিদ কর্মস্থলে যোগ দিয়ে প্রায় ১২ বছরের বকেয়া বেতনসহ চাকরি নিয়মিতকরণে অধ্যক্ষ বরাবর আবেদন করেন। এরপর অর্ধবছর কেটে গেলেও চাকরি নিয়মিত বা বকেয়া টাকার দেখা পান না ফরিদ। বকেয়া ফেরত পেতে অধ্যক্ষকে মুচলেকা দিতে বাধ্য হন তিনি। ২০১৬ সালের ৩ জুলাই দেওয়া ওই মুচলেকায় ফরিদকে দিয়ে লেখানো হয়, ‘আমি সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালীন ওই সময়ের মোট বেতনের ৪৫ শতাংশ টাকা কলেজের উন্নয়নে প্রদান করবো। ’
মো. ফরিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয়রা শত্রুতার জেরে আমার বিরুদ্ধে মাদক মামলা দেয়। এতে আমার জীবন থেকে প্রায় ১২ বছর হারিয়ে গেছে। নিরপরাধ প্রমাণ হওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পাই। অধিদফতর থেকে চাকরি নিয়মিতকরণ ও বকেয়া পরিশোধ করতে নির্দেশ দিলেও গড়িমসি শুরু করেন অধ্যক্ষ। টাকা পেতে হলে বকেয়া টাকার অর্ধেক দিতে শর্ত দেন। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে আমি ৪৫ শতাংশ টাকা দিতে রাজি হই। তিনি এটা আমাকে দিয়ে লিখিয়েও নেন। টাকা তোলার দিন অধ্যক্ষ ওই কলেজের ক্যাশিয়ার ইউনুসকে আমার সঙ্গে ব্যাংকে পাঠান। তিনি টাকা তুলে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা আমার হাতে তুলে দেন। এ বিষয়টি কলেজের সব কর্মচারী-কর্মকর্তারা জানলেও অধ্যক্ষের ভয়ে কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি।
জানা যায়, ২০১৫ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন অধ্যাপক মো. বিল্লাল আলম। যোগ দিয়েই তিনি মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘সন্ধানী’র কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। সেই থেকে এ পর্যন্ত সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এটিকে খুলে দেওয়ার দাবি জানানো হলেও তা আমলে নেননি অধ্যক্ষ।
সম্প্রতি কলেজের জন্য বাস কিনতে শিক্ষকপ্রতি ৫ হাজার টাকা ধার্য করেন অধ্যক্ষ। কলেজের প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকারও বেশি আদায় করেন তিনি। এই অর্থ দিয়ে তিনি ৪২ সিটের একটি বাস কেনেন। এই বাস কিনতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও ১০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাস কিনতে ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বাকি টাকার কী হয়েছে তা কেউ-ই জানে না।
কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ছাত্র সংসদ তিনি খুলে না দিয়ে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার নামে একটি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। ছাত্র সংসদের টাকা সেই সংগঠনের কাজে ব্যয় করছেন। এমনকি চাঁদার টাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য যে গাড়ি কেনা হয়েছে, সেটিও প্রায়-ই নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে জানান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও অধ্যক্ষের সঙ্গে মত বিরোধের কারণে তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি, এমনকি তার ছাত্রত্বও স্থগিত করে রাখা হয়েছে। অথচ তার শিক্ষার বয়স শেষের দিকে। এখনও যদি তাকে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া না হয়, তাহলে কোনোদিন তার এমবিবিএস পাশ করা হবে না।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বাংলানিউজকে জানান, নন অডিটেড ফান্ড যেমন: ছাত্র সংসদের অর্থ, কল্যাণ ফান্ডের অর্থ- এগুলো তিনি নিজের ইচ্ছামতো ব্যয় করেন। কারণ নন অডিটেড ফান্ডের অর্থ খরচের কোনো জবাবদিহি নেই। অথচ কলেজের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্ধকৃত অর্থ ফেরত যায়।
এসব বিষয়ে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ডা. খান মো. আরিফ বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. বিল্লাল আলম একজন আধিপত্যবাদী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। তিনি যেটি করতে চান সেটির বিরুদ্ধে কেউ কোনো মত দিলেই তার বিরুদ্ধে তিনি ক্ষেপে যান। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে নাজেহাল করেন। তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় আমাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনিই ‘সন্ধানী’র কার্যক্রম বন্ধ রেখেছন।
‘কিন্তু কোনো মেডিক্যাল কলেজে এ ধরনের সংগঠন কোনোদিন বন্ধ হয় এমনটা শুনিনি। ছাত্র সংসদের টাকা তিনি ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পেছনে ব্যয় করেন। এমনকি কলেজের কোন খাতের টাকা তিনি কিভাবে ব্যয় করেন সেটি অন্যান্য শিক্ষকদের জানানোর প্রয়োজনও মনে করেন না। একজন শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধাচারণ করায় তিনি তার শিক্ষাজীবন ব্যাহত করতে পিছপা হননি। যা অত্যন্ত অমানবিক। ’
সমিতির প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বাংলানিউজকে বলেন, সন্ধানী স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত একটি সংগঠন। আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত এই সংগঠনের কার্যক্রম কোনোভাবেই বন্ধ করা ঠিক হয়নি।
বাস কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোনো ধরনের কেনাকাটা করা অনৈতিক। তাছাড়া তিনি কতো টাকা চাঁদা তুলেছেন, কতো টাকা ব্যয় হয়েছে তার কিছুই শিক্ষকদের জানাননি। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা বলেই দাবি করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. বিল্লাল আলম।
এমএলএসএস মো. ফরিদুল ইসলামের পাওনা টাকা কেটে নেওয়ার বিষয়টি তার মনে নেই- দাবি করে ডা. বিল্লাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি জীবনে কোনোদিন হারাম স্পর্শও করিনি। ’
‘সন্ধানী’ প্রসঙ্গে তিনি জানান, তিনি নিজেই সন্ধানী করতেন। বর্তমানে কলেজে ‘সন্ধানী’র কার্যক্রম স্থগিত থাকায় তিনিই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে মারামারি হতে পারে এই আশঙ্কায় এটিকে বন্ধ রাখা হয়েছে।
গাড়ি কেনা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, ‘এটি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেনা হয়েছে। তবে কতো টাকা ব্যয় হয়েছে আমি তা জানি না। ’
একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যাহত করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটির সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত নই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৯ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৯
এমএএম/এসএ/এইচএ/