বাংলাদেশে প্রথমবার আসা, এখানকার মানুষের ভালোবাসা, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে ওঠাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয় বাংলানিউজের সঙ্গে।
১৯৯৯ সালে আমেরিকার উইসকনসিন মেডিক্যাল কলেজে পড়া অবস্থায় (এমবিবিএস প্রথম বর্ষ) প্রথম বাংলাদেশে আসেন জেসন।
২০১৮ সালে জুন মাসে এখানে এসে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি বেশি জোর দেন তারা।
জেসন বলেন, সবাই মনে করে আমেরিকার বিলাসী জীবন। আসলে তো তা না, সেখানেও ব্যস্ত থাকতে হয়। এখানে এসেছি গরিব মানুষের সেবা করার জন্য। বাঙালি পোশাক আমাদের দুই জনেরই ভালো লাগে। ডাক্তার ভাই (এড্রিক বেকার) মারা যাওয়ার পর সবকিছুতেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তিনি যে পদ্ধতি শিখিয়েছেন তা দিয়েই চলছে। সবাই আন্তরিকভাবে কাজগুলো করে।
কথা হয় ওই হাসপাতালে ভর্তি রোগী কালিয়াকুড়ি এলাকার গফুর মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, নতুন ডাক্তার ভাই এবং ভাবী খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দেয়। আগের মতোই নামমাত্র দামে ওষুধ দেওয়া হয়।
অপর রোগী উপজেলার বেড়িবাঁধ এলাকার হাবেল মিয়া জানান, বাংলাদেশের ডাক্তারদের চাইতে এরা অনেক বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দেয়। আমরা বিদেশে না গিয়ে বিদেশি ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে পারছি।
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও শুরুর কথা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানিদের হত্যা, বর্বরতা, ভারতগামী শরণার্থীদের ছবি নিয়মিত ছাপা হতো। এ দেখে নিউজিল্যান্ডের তরুণ চিকিৎসক এড্রিক বেকারের মন কাঁদতো। এড্রিক বেকার মনে মনে সংকল্প করেন, এদেশে আসবেন। ৭১ সালে কাজ করছিলেন ভিয়েতনামের একটি মেডিক্যাল টিমে। ডিসেম্বর বিজয়ের খবর শুনে খুবই উল্লাসিত হন। ওই বছরই তিনি বাংলাদেশে আসেন। এরপর ৩৬ বছর ধরে মধুপুরে অবস্থান করে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে এড্রিক বেকারের জন্ম। তার বাবা ছিলেন পরিসংখ্যানবিদ। মা বিট্রি বেকার শিক্ষক। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এড্রিক ডুনিডেন বেকার শহরের ওটাগো মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের সার্জিক্যাল টিমে যোগ দিয়ে চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে কাজ করেন ’৭৫ সাল পর্যন্ত। মাঝে অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স করেন ট্রপিক্যাল মেডিসিন, গাইনি, শিশু-স্বাস্থ্য বিষয়ে। ১৯৭৬ সালে পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান। কিন্তু কোথাও মন টেকেনি। এরই মধ্যে এস এড্রিক বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দু’বছর ও পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ৮ মাস কাজ করেন। বেকারের বড় কোনো হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছে কখনও ছিল না। ইচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার। অন্যরকম কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসেন টাঙ্গাইলের মধুপুর পাহাড়ি গড় এলাকায়। তখন সাধারণ মানুষের মাঝে কাজ করতে গিয়ে মনে হলো ভাষা শিক্ষার নেওয়া দরকার। তাই মধুপুরের জলছত্র খ্রিস্টান মিশনে এক বছর থেকে বাংলা ভাষা শিখেছেন। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় কাইলাকুড়ি গ্রামের অবস্থান। এলাকার আদিবাসী-বাঙালি প্রায় সবাই দরিদ্র। এ রকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায় চার একর জায়গার উপর ডা. এড্রিক বেকারের স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা:
ছোট ছোট মাটির ২৩টি ঘরে হাসপাতালের ডায়েবেটিস বিভাগ, যক্ষ্মা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগ, ডায়রিয়া বিভাগসহ আলাদা বিভিন্ন বিভাগে ৪০ রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আগত রোগীদের সবাই দরিদ্র। তবে এখানে টাকা উপার্জনকারী স্বচ্ছল ও ধনী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। এখানে বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ১০০ জন রোগী দেখা হয়। এছাড়া হাসপাতালে কমপক্ষে ৪৫ জন রোগী সবসময় ভর্তি থাকে। বহির্বিভাগে নতুন রোগী এলে টিকিট কাটতে হয়। নতুন রোগীর জন্য টিকিটের মূল্য ২০ টাকা এবং পরবর্তীতে ১০ টাকা। তবে রোগী যদি গ্রাম কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে টিকিটের মূল্য ৫ থেকে ১০ টাকা। কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগীকে পাঠানো হয় নির্দিষ্ট প্যারামেডিকের কাছে। ছোট খাটো অসুখের ক্ষেত্রে প্যারামেডিকরাই বলে দেন রোগ নিরাময়ের উপায়। জটিল কোনো রোগের ক্ষেত্রে আছেন এমবিবিএস ডাক্তার। রোগ নির্ণয় শেষে নামমাত্র মূল্যে মিলবে ওষুধ। গুরুতর অসুখ হলে প্রয়োজনে রোগীকে ভর্তি করে নেওয়া হয় হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে। আছে জরুরি বিভাগও। সবসময় ডাক্তাররা রোগীর খোঁজ খবর নেন।
এক রোগী জানালেন, হাসপাতাল শব্দটি শুনলেই সচরাচর যে দৃশ্যগুলো চোখে ভাসে, তার সঙ্গে মিলবে না একদমই। প্রকৃতি, আধুনিকতা আর সেবার ব্রত মিলেমিশে একাকার এখানে। সত্যিকারের সেবার ব্রত আছে বলেই হাসপাতালের রোগীরা আনন্দিত।
হাসপাতালের সমস্যা সমূহ
গরিব মানুষের এ হাসপাতালে এখন অনেক সমস্যা রয়েছে। এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন না থাকায় অন্য সংস্থার নামে ফান্ড এনে হাসপাতাল চালাতে হয়। এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে সমাজসেবার নিবন্ধন রয়েছে। যার নিবন্ধন নং- ট-ম-২৪০২/২০১৭। ৮০ জন জনবল নিয়ে দু’জন দেশি ও দু’জন বিদেশি ডাক্তারের সমন্বয়ে চলছে এ হাসপাতাল। অর্থসংকট, জনবল সংকট, ওয়ার্ড সংকট, অবকাঠামো, প্রাচীর নির্মাণ, পাকা স্যানিটেশনসহ নানান সমস্যা রয়েছে। এসব কাজ করতে পারলে আরো বেশি রোগী ও সেবার মান বৃদ্ধি করা যাবে বলে মনে করছে এখানকার সাধারণ মানুষ।
সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক পিজন নংমিন বাংলানিউজকে জানান, এটা গরিব মানুষের হাসপাতাল। গরিব রোগীদের সেবা করা হয়। প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ জন রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। এদের জন্য বসার সিট, স্যানিটেশন, থাকার ঘর অর্থ সংকটসহ নানা অসুবিধা রয়েছে। জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করা যায় না। তাদের ঢাকাসহ দেশের নানা হাসপাতালে রেফার করা হয়।
গরিব রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে এখানে ৮০ জন স্টাফ, দু’জন দেশি, দু’জন বিদেশি ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। আরো চিকিৎসক দরকার। এ হাসপাতালের মডেল দেখার জন্য এখানে দেশি-বিদেশি অনেক লোক আসে। তবে এখানে ধনী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। মাটির ২৩টি ঘরে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ডাক্তার থাকার ঘর থেকে শুরু করে সব ঘর মাটির। সেজন্য বৃষ্টিরদিনে সমস্যায় পড়তে হয়। রোগীর ধরণ অনুযায়ী পৃথক পৃথক ঘরে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও চোখ ও দাঁতের রোগীর জন্য আলাদা ভাবে ২/৩ মাস পর পর বিএনএসবি ময়মনসিংহ ও বারডেম থেকে আসা ডাক্তারদের নিয়ে ক্যাম্প করা হয়।
তিনি বলেন, দিনের শুরুতে প্রতিদিন সকালে কোরআন, গীতা ও বাইবেল পাঠ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন দিবস পালনের পাশাপাশি গরিবের ডাক্তারের (এড্রিক বেকার) মৃত্যুদিবস পালন করা হয়। এ দিবসে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, বিশেষ প্রার্থনা ও রোগীদের বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৯
এসএইচ