ঢামেক হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, এই হুইল চেয়ারগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন ঢামেকের কয়েকজন ওয়ার্ড মাস্টার। তারাই মূলত হাসপাতালের হুইল চেয়ারগুলো বেশ কয়েকজন নারীর হাতে তুলে দিয়েছেন।
বেসরকারি একটি কোম্পানির ম্যানেজার রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, আমার মা সালমা বেগমের বয়স ৫৬ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে কয়েক দিন আগে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাই। বিকেলের দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সিএনজি থেকে নামার পর মধ্যবয়সী এক নারী হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসে। বলে, স্যার মা-কে নিয়ে আসছেন, বয়স্ক মহিলা হাঁটতে পারবেন তো? আমার হুইল চেয়ারে বসান। ওনার কথা শুনে মাকে ধরে তার হুইল চেয়ারে বসাই। পরে জরুরি বিভাগ থেকে আমার মা-র নামে একটি টিকিট নিলাম ১০ টাকা দিয়ে।
‘এরপর ইমারজেন্সিতে ডাক্তারকে দেখাই। ওনি রেফার করেন মেডিসিন ওয়ার্ডে। হাসপাতালে কোনো কিছুই কিন্তু আমি চিনি না। ওই মহিলাই আমাকে সব চিনিয়ে দিচ্ছেন। পরে মেডিসিনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। হাসপাতালে এক্সরে করিয়ে ওই হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় মাকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে বলেন, আপনার মা বয়স্ক, কিছু সমস্যা আছে। তবে, এগুলো তেমন গুরুতর নয়। কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। ঠিক হয়ে যাবে। পরে আমি আবার জরুরি বিভাগে আসি। ওই নারীর হুইল চেয়ারে বহন করে আমার মা-কে জরুরি বিভাগের সামনে থেকে একটি সিএনজিতে তুলে দেয়। ’
এরপর যা ঘটলো তা অত্যন্ত অপমানজনক এবং বিব্রতকর বললেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি খুশি হয়ে তাকে ৫০ টাকা দিলাম। এই টাকা দেখে ওই ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে উঠেন। কি, ভিক্ষা দিলেন নাকি? আমরা কি ভিক্ষুক নাকি? এত কষ্ট করে আপনার মাকে বহন করলাম কি মাগনা মাগনা? অনেক কথা বললো আরও। নাইবা বললাম সেগুলো। পরে বাধ্য হয়ে তাকে ৩০০ টাকা দিতে হলো। ’
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন হুইল চেয়ার নিয়ে ঘোরে বেড়ায়। পারুল, শারমিন, মমতাজ, রত্না ও শাহানাজ তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের লক্ষ্য থাকে, রোগীদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে টাকা আদায় করা। এরমধ্যে পারুল চাহিদামতো টাকা না পেলে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।
এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে পুরাতন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমান ও আবুল বাশার আর নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেন হুইল চেয়ার নিয়ে নৈরাজ্যের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকা বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা জানান, ওয়ার্ড মাস্টাররা কখনোই এসব বিষয়ের সঙ্গে জড়িত নয়।
তবে তারা নারী দালালদের হুইল চেয়ার নিয়ে এমন নৈরাজ্য সৃষ্টির বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তারা জানান, হুইল চেয়ারকে ঢাল বানিয়ে রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। হাসপাতালে নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা আনসার সদস্যরা একটু তৎপর হলেই নারী দালালদের রোধ করা সম্ভব। কিন্তু তারা তৎপর নয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আনসারের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) মোসলেম উদ্দিন এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হাসপাতালের পরিচালকের নির্দেশে কয়দিন পর পরই হুইল চেয়ারের দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। এক মাস আগেও হুইল চেয়ার দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৪টি হুইল চেয়ার জব্দ করে হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পে জমা দেওয়া হয়েছিল। আবার নির্দেশ পেলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল পুলিশ ক্যাম্পের ইন্সপেক্টর বাচ্চু মিয়া ১৪টি হুইল চেয়ার জব্দের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার ও অন্যরা লিখিত দিয়ে হুইল চেয়ারগুলো তাদের আয়ত্তে নিয়েছে।
লিখিত দেওয়া ওই লিখিত আবেদন পত্রে দেখা যায় পুরাতন ভবনের কেবিন ব্লকের ওয়ার্ড মাস্টার শরিফুল ইসলামের বহির্বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল বাশারের নাম রয়েছে।
কেন তাদের নাম ওই আবেদন পত্রে জানতে চাওয়া হয় ওই দুই ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে। তারা জানান, অভিযানের সময় তাদের আন্ডারের ওয়ার্ডগুলোতে রোগী নামানোর সময় ওই হুইল চেয়ারগুলো জব্দ করে আনসার সদস্যরা। পরে তারা পুলিশের কাছে লিখিত দিয়ে হুইল চেয়ারগুলো নিয়ে আসেন। চেয়ারগুলো তাদের আন্ডারেই রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২০
এজেডএস/এইচএডি/