মাগুরা: ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়ে যায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট দেবদাস মণ্ডলের (৩৫)। গত কয়েক মাসের বেশি সময় ধরে মাগুরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছুটে তাকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বা উপসর্গ বিশিষ্ট মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছে।
মাগুরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট গত কয়েক মাসে এক হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছেন। প্রথমে এ কাজ করতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লেও এখন অন্যদের সাহস যোগাচ্ছেন করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ সারির এ যোদ্ধা।
জেলার চার উপজেলায় চারটি দল কোভিড-১৯ উপসর্গ বিশিষ্ট মানুষের নমুনা সংগ্রহ করেন। প্রতিটি দলে একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের নেতৃত্বে রয়েছেন একজন ইপিআই টেকনিশিয়ান। এর মধ্যে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে একটি এবং শ্রীপুর ও শাখিলা উপজেলায় একটি করে দল নমুনা সংগ্রহের কাজ করে থাকেন। তবে লোকবল সংকট থাকায় দেবদাসকে একাই সামলাতে হয় দুই উপজেলা। দু’জন ইপিআই টেকনিশিয়ান নিয়ে সদর উপজেলা ও মহম্মদপুরের নমুনা একাই সংগ্রহ করেন তিনি।
মাগুরা সদর হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান শাহিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা দু’জন মাগুরা সদর ও মহম্মদপুর উপজেলায় করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে থাকি। এ কাজ করতে গিয়ে আমাকে পরিবার থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়। প্রায় চার মাস হলো আমি আমার সন্তানকে আদর করতে পারি না। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার থেকে দূরে থাকি। তবে প্রত্যাশা করি, একদিন আমাদের ভালো সময় আসবে। ’
২০০৮ সালে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের চাকরিতে আসেন দেবদাস মণ্ডল। তার বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার মৃগিডাঙা গ্রামে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন শহরের হাসপাতাল পাড়ায়। তিনি জানান, নমুনা সংগ্রহের কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বাবা-মা চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছেন কয়েকবার। এ পরিস্থিতিতে গত তিন মাস স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে শহরে একাই থাকছিলেন তিনি। খাওয়া-দাওয়ার সমস্যার কারণে এক সপ্তাহ হলো তাদের শহরের বাসায় নিয়ে এসেছেন।
দেবদাস জানান, শুরুর দিকে ভয় ছিল বেশি। তখন কেউ মিশতে চাইতো না। তাকে হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে না করা হতো। দুই সপ্তাহ পর প্রথম তার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে। তারপর ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে তার। এভাবে গত তিন মাসে তিনবার নমুনা দিয়ে প্রতিবারই নেগেটিভ এসেছে তার।
এ সময়ের মধ্যে অনেক কঠিন ও বেদনাদায়ক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন দেবদাস। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। ৩ এপ্রিল মহম্মদপুরে করোনা উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তি মারা যান, তাকে দিয়েই নমুনা সংগ্রহ শুরু। সবশেষ ৬ জুলাই শহরের আদর্শপাড়ায় যে অন্তঃসত্ত্বা নারী মারা গেলেন, তার নমুনাও আমিই সংগ্রহ করি। এভাবে জেলায় আক্রান্তদের একটি বড় অংশের নমুনা আমি সংগ্রহ করেছি। ঈদের দিন বাদে গত সাড়ে তিন মাসে একদিনও ছুটি কাটাইনি। ভয় শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তাছাড়া আনন্দ নিয়েই কাজ করি। শুধু এটুকুই ভাবি মানুষের জন্য জীবনে এতো বড় কাজ করার সুযোগ আগে কখনো পাইনি। ’
মাগুরা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবু সাইদ মোল্ল্যা বাংলানিউজকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করা খুব কঠিন কাজ। দেবদাস মণ্ডল শুরু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আসছেন। অনেক সময় দেখা যায় অনেকে যেখানে দুশ’ নমুনা সংগ্রহ করতে পারেন নাক, সেখানে দেবদাস প্রায় এক হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে বিলেয়ে দিয়েছেন। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তার জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ তাকে সুস্থ রাখেন। ’
মাগুরা সিভিল সার্জন প্রদীপ কুমার সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহের কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং দক্ষ লোক ছাড়া সম্ভব না। সেই সঙ্গে কাজটি যথেষ্ট পরিশ্রমের। বেশিরভাগ সময় মোটর সাইকেলে করে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের লোকবল সংকট থাকায় দেবদাস মণ্ডল একাই দুই উপজেলার নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন। তিনি নিজ আগ্রহ থেকেই কাজ করেন। কখনো কখনো একই দিনে দুই উপজেলাতেও কাজ করতে হয় তাকে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২০
এফএম