ঢাকা: অনুমতি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান চালাতে পারবে না। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এমন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
প্রশ্ন উঠছে, হাসপাতালে অভিযানের বিরুদ্ধে এমন নিষেধাজ্ঞা কার স্বার্থে?
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটি পক্ষে মনে করছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র আড়াল করতেই স্বাস্থ্য বিভাগ এমন নির্দেশনা দিয়েছে।
অপর পক্ষের মত, হাসপাতালে একাধিক বাহিনীর অভিযানের ফলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। তাই অভিযানের পূর্বে অনুমতির প্রয়োজন আছে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, “দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একমুখী। চিকিৎসা নিতে গিয়ে কেউ যদি প্রতারিত হয়, তাহলে সেই প্রতারণার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। আগে মানুষ পুলিশের কাছে অভিযোগ করতো। কিন্তু যখন মানুষ দেখলো পুলিশও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তখন মানুষ র্যাবের কাছে অভিযোগ দেওয়া শুরু করলো। এরপর র্যাব অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে। র্যাবের এই কাজতো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করার কথা। কিন্তু মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালন না করে যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য। ”
তিনি আরও বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর কোনো প্রতিকার বা প্রতিবিধান এখনও হয়নি। তাই অভিযানের আগে অনুমতি নেওয়ার নির্দেশনা মানে বড় কোনো দুর্নীতি আড়াল করা চেষ্টা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুমোদন লাগবে, এর অর্থ যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ছিলেন, তারা ভেবেছেন বা তাদের কেউ কেউ মনে করেছেন চুনোপুঁটি টানাটানি করলে রুই-কাতলা বেরিয়ে আসতে পারে, যা তাদের একটি অংশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যোগসাজশের কারণে হোক বা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কারণেই হোক, বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস নেই যে, তারা তাদের দায়িত্ব স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়ে পরিচালনা করতে পারেন। এই আত্মবিশ্বাস থাকলে পূর্বানুমতির বিষয়টি লাগার কথা নয়। অভিযান শব্দটি নিয়ে তো শঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না, যদি সততার সঙ্গে, জবাবদিহিতার সঙ্গে কাজ করা হয়। ”
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, “সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অনিয়ন্ত্রিত নীতির চিত্র প্রকাশের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, এটা সেই প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন। এই নির্দেশনা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি সহায়ক হবে। ”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “আমি মনে করি, শুধু স্বাস্থ্যখাতের নয়, সরকারি বা বেসরকারি কোনো ধরনের দুর্নীতি এবং অনিয়ম আড়াল করতে চাওয়া উচিৎ নয়। অন্যদিকে আবার অনিয়ম দুর্নীতি খুঁজতে গিয়ে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, সেগুলোও হওয়া উচিৎ নয়। একইসঙ্গে আমাদের আইনকানুনগুলোকে আরও আপডেট করতে হবে। শুধু কনজিউমার প্রটেক্টেড আইন দিয়ে হবে না, পেসেন্ট প্রটেক্টেড আইন করা দরকার। ”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “নিজেদের লোকজনকে রক্ষা করার জন্য এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি এবং দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অন্যায় দুর্নীতি হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক দুর্নীতি বেরিয়ে এসেছে, বাকিগুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে একটা চরম দুর্বৃত্তায়ন চলছে, এই দুর্বৃত্তায়নের মূলোৎপাটনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখি না। এর ফলে এই খাতের গড ফাদারদের তারা রক্ষা করছে। চুনোপুঁটি ধরে কোনো লাভ হবে না, যদি রাঘব বোয়ালদের না ধরা হয়। এটা আওয়ামী লীগের সমস্যা না, এটা সরকারের সমস্যা না, এটা পুরো জাতির সমস্যা। এটা জাতীয়ভাবেই সমাধান করতে হবে। এ জন্য জাতীয় ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। সম্মিলিতভাবে এই সমস্যার সমাধান করা উচিৎ। ”
বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২০
আরকেআর/এজে