ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

‘জীবনের জন্য কিডনি’

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১২
‘জীবনের জন্য কিডনি’

ঢাকা : ৮ মার্চ বৃহস্পতিবার বিশ্ব কিডনি দিবস। এবার দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জীবনের জন্য কিডনি’।

কিডনি রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।

দিবসটি উপলক্ষে সকালে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট থেকে একটি র‌্যালি বের করে বাংলাদেশ রনোল অ্যাসোসিয়েশন, কিডনি ফাউন্ডেশন, পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি সোসাইটি অব বাংলাদশে, সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্ট বাংলাদশে ক্যাম্পস এবং ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদশ। র‌্যালিটি সেগুনবাগিচার বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে।

পরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কিডনি দিবসের এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকির।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, মহাসচিব অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক মতিউর রহমান।

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুহাম্মদ রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসিচব অধ্যাপক ম. মহিবুর রহমান, ক্যাম্পস এর সভাপতি অধ্যাপক এম এ সামাদ, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সোসাইটি অফ অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন- এর সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ প্রমুখ।

এছাড়াও জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্ঠির লক্ষ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে উন্মুক্ত মঞ্চে বিকেল ৫টা থেকে কিডনি রোগ বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কিডনি রোগ থেকে মুক্ত থাকতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জনসাধারণকে নানা পরামর্শ দেবেন।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশে প্রতি বছর কিডনিজনিত রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায় এবং দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে ভুগছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না।

কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে।

বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তাঁর বাণীতে বলেছেন, কিডনি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ কারণে বিশ্বে কিডনি রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। দেশের বিপুল সংখ্যক কিডনি রোগীর চিকিৎসা ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্ডের মাধ্যমে করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার।

আর কিডনি রোগের কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের সচেতনতা করতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। এদের মধ্যে সম্পূর্ণ কিডনি বিকল রোগীদের বাঁচার জন্য ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি ট্রান্সপ্রান্ট করতে হয়। দেশের দরিদ্র জনগণের পক্ষে ডায়ালাইসিসের বিপুল খরচ বহন করা খুবই দুরুহ। নিকট আত্মীয়দের কিডনি দান বা মরণোত্তর কিডনি দানের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের দ্বারা এই সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব। ’

সকল চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কিডনি প্রতিস্থাপন ও কিডনি রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। দেশে এখনও কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

এদিকে গত বছর কিডনি নিয়ে নানা ঘটনা ঘটে গেছে, যার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। সরকারি হাসপাতালে শুরু হলেও বেসরকারি হাসপাতালে এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম।

কিডনি কেনাবেচা নিয়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনার জের এখনও রয়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের মনে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল উৎসাহ দেখাচ্ছে না।

দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুব ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সফলতার মাত্রা খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে।

কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. শহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলানিউজকে জানান, বিভিন্ন কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কারো কারো কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালীন জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাইটিস, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনির পাথরের কারণে হঠাৎ করেও কিডনি অকেজো হয়ে যায়।

তিনি বলেন, এ ধরনের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার ভাল দিক হচ্ছে, এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা করলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়।

ডা. সেলিম বলেন, ‘এদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হওয়াকে প্রতিরোধ করতে হলে বিশুদ্ধ খাবার ও পানি পান করতে হবে। ’

তিনি বলেন, রক্তক্ষরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিতে হবে। ইনফেকশন হলে তার সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়।

কিডনি রোগের খরচ সর্ম্পকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে প্রতি ডায়ালাইসিসের খরচ ৮শ’ টাকা হলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে লাগে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।

বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে অধ্যাপক সেলিম বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য।

তিনি জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দু’ দিন আগে থেকে পরবর্তী জীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দু’টি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দু’টি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দু’টি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল(১০০এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা।

এছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দু’টি ইনজেকশন দিতে হয়। এই প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহার করতে হওয়ার কারণে ওই দু’টি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক দরিদ্র পরিবার। তাই ওই দু’টি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে।

এদিকে, বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি হাসপাতালে বিনা টাকায় শারীরিক পরীক্ষা বিশেষ করে কিডনি রোগের জন্য প্রস্রাব ও রক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আগত রোগী ও রোগী সতীর্থদের কিডনি-মূত্রতন্ত্রের (কিডনিনালী, প্রস্রাবের থলি, প্রোস্টেট গ্রন্থি, মূত্র নালী) রোগ ও এর প্রতিরোধ প্রতিকার সম্পর্কে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করন কর্মসূচি। রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ পদ্ধতি তুলে ধরে লিফলেট বিতরণ, পোস্টার প্ল্যাকার্ড, ব্যানার প্রদর্শনী।

কিডনি রোগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন কিডনি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া।

এ্যাপোলো হাসপাতালের এম এইচ সি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য কথার আয়োজন করা হয়েছে।

বুধবার রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে দি বারাকাহ কিডনি হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও ইউরোলজী ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এস এ খান, অধ্যাপক ডা. মো. ফিরোজ খান, অধ্যাপক ডা. এম ফখরুল ইসলাম প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময় : ১২২৬ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।