কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত মন্ডল গত বছরের ১১ আগস্ট গ্রেফতার হন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) হাতে। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তথা বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত এখন নয়াদিল্লিতে ইডির হেফাজতে।
অবশ্য দিদির (মমতা বন্দোপাধ্যায়) ছত্রছায়ায় এতদিন তাতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এবার তাকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছে ইডি। সেখানেই তদন্তকারীদের সামনে ভারতীয় আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধ আইনের ৫০ নম্বর ধারা অনুযায়ী নিজের বয়ান লিখতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ে যান অনুব্রত ওরফে মমতার কেষ্ট। কাঁদো কাঁদো গলায় বীরভূমের বাঘ বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) ইডির সামনে বলেছেন, ‘স্যার, আমি লিখতে পারি না। চেকে সই করার জন্য শুধু নাম সই করতে পারি। ওইটুকুই শিখেছি। ’ একথা শোনার পর রীতিমতো মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন ইডি কর্তারা। তারপর নিয়ম মেনে একজন নিরপেক্ষ সাক্ষীকে এনে হাজির করেন ইডির এক স্পেশাল ডিরেক্টর। অনুব্রতর দেওয়া উত্তর লিখে দেন সেই নিরপেক্ষ।
শেষে বীরভূমের জেলা সভাপতিকে পুরো বয়ানটি পড়ে শোনানো হয়। তাতে সম্মত হওয়ার পর শুধু সই করেন কেষ্ট। তিনদিনের ইডি হেফাজত শেষে শুক্রবার (১০ মার্চ) অনুব্রতকে ফের দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে হাজির করা হবে। আরও কিছুদিন তাকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে চায় ইডি। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তার অনুগামী সূত্রে খবর, দাদার (অনুব্রত) লেখাপড়া টেনেটুনে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। এইটে উঠেছিলেন কি না, তা রহস্যাবৃত! মুদির দোকান এবং গ্রিলের কারখানায় কাজের মধ্য দিয়ে আয়-ইনকামের হাতেখড়ি। পরে বাজারে মাছের ব্যবসা করতেন। এই পেশাগুলোয় কলম ধরার প্রয়োজন হয়নি। তাই লেখাপড়ার প্রয়োজন হয়নি।
মমতা ক্ষমতায় আসার পর একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলেন কেষ্ট। তাই চেক জমা দিতে সই করাও শিখে নেন। কিন্তু, এবার গোটা বয়ান তাকে লিখতে হবে শুনেই চোখ কপালে ওঠে। তিনি ইডির কাছে জানতে চান, ‘স্যার কেন এটা লিখতে হয়?’ ইডি কর্তারা জানান, আদালতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলতে না পারেন, তার বয়ান জোর করে বা ভয় দেখিয়ে লেখানো হয়েছে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। প্রিভেনসন অব মানি লন্ডারিং (পিএমএল) অ্যাক্ট অনুযায়ী এই বিশেষ ক্ষমতা ইডিকে দেওয়া হয়েছে। এটি গোপন জবানবন্দির সমান। এরপরই বীরভুমের বাঘ নিজের থাবা গুটিয়ে নেন।
৭ মার্চ মধ্যরাতে দিল্লির অশোক বিহারে রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টের বিচারক রাকেশ সিংয়ের কাছে অনুব্রতকে ভার্চ্যুয়ালি পেশ করা হয়। ইডির দাবি, ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে, ৬ দিনে সাড়ে ছয় কোটি রুপির সম্পত্তি কিনেছেন অনুব্রত নিজের মেয়ে এবং প্রয়াত স্ত্রীর নামে। সেসব কেনা হয়েছিল নগদ অর্থে। ইডির দাবি, গরু পাচারের প্রোটেকশন মানি এবং অবৈধ কয়লা পাচারের টাকায় এ সম্পত্তি কেনা হয়েছিল।
অনুব্রত জানিয়েছেন, এতবছর হয়ে গেছে তার মনে নেই। ইডির বক্তব্য, অনুব্রত তথ্য গোপন করে অসহযোগিতা করছে। শুধু এই অর্থ নয়, ইডির দাবি, বাজার মূল্য থেকে কম মূল্য দেখিয়ে কোটি কোটি রুপির বহু সম্পত্তি কিনেছেন অনুব্রত। ইডি একটি সম্পত্তির তালিকা তৈরি করেছে, যেখানে রকেটের গতিতে কোন সময়ে, কোথায়-কোথায় তার স্ত্রী ছবি মন্ডল, কন্যা সুকন্যা মন্ডল এবং নিজের নামে সম্পত্তি কেনা হয়েছে। সম্পত্তি বাদেও ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৫ কোটি ৯২ লাখ রুপির ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট পেয়েছে ইডি।
এসব তথ্য তার জানা নেই বলে অনুব্রত প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যাঙ্কের নথিতে তার সই দেখাতেই ব্যাকফুটে চলে যান কেষ্ট। একাধিক ব্যাঙ্কে কীভাবে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ঘুরে মানি ট্রেইল হয়েছে, সেই নথি দেখানোর পর কেষ্ট কার্যত চুপসে যান বলে তদন্তকারীদের দাবি। অর্থের রহস্যভেদে ইতোমধ্যে তার মেয়ে সুকন্যাকে ডেকে পাঠিয়ে বাবার সঙ্গে মুখোমুখি বসানোর পরিকল্পনা করছে ইডি।
প্রসঙ্গত, কয়লা, গরু পাচারসহ একাধিক মামলা চলছে অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে। শঙ্খ ঘোষের মতো কবির স্বমন্ধে প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন বীরভূমের এই নেতা। তাতে গোটা বাংলায় হইচই পড়ে গেলেও শাসক দল মুথে কুলুপ এটেছিল। এতেই বোঝা গিয়েছিল এই নেতার কত দাপট! পরবর্তীতে বীরভূমের বগটুইতে গণহত্যা ঘটে। সেখানে শিশু-নারীসহ ১০ জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অনুব্রতর দিকে আঙুল তুলেছিল ভারতের তদন্তকারী সংস্থাটি। সামান্য মাছ ব্যবসায়ী থেকে বর্তমানে হাজার কোটি রুপি সম্পত্তির মালিক কি করে হলেন? কি করে তুলতেন এত টাকা? এ টাকা কি তার কাছেই থাকতো? নাকি উচুঁ তলায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো? এসব তথ্যই জেরা করছে ইডি।
বারেবারে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে গেছেন অনুব্রত। এখন আর সেই সুযোগও নেই। কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, দিল্লির রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব হওয়ার বিষয়টি জানান। পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৩
ভিএস/এসএ