কলকাতার মারকুইস স্ট্রিট; যেখানে নানা কাজে প্রতিদিন শত শত বাংলাদেশি যান। তবে মারকুইস স্ট্রিটের বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বাংলাদেশিদের বিপদ ডেকে আনছে।
ভ্রমণ, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজে প্রতি বছর ভারতে আসেন বাংলাদেশিরা। তারা পশ্চিমবঙ্গে পা রাখলে বেছে নেন কলকাতার মারকুইস স্ট্রিট। কারণ, এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সব কিছু নাগালের মধ্যে থাকায় দীর্ঘ বিশ বছরের বেশি সময় ধরে মারকুইস স্ট্রিটেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বাংলাদেশিরা। আর তাদের কারণে অনেকটাই উজ্জীবিত কলকাতার নিউমার্কেট থেকে বড়বাজার।
এখানে যেমন বাংলাদেশিদের থাকার জন্য রয়েছে প্রচুর হোটেল, বাঙালি রেস্তোরাঁ, মানি এক্সচেঞ্জ, শপিংয়ের জন্য নিউমার্কেট, ব্যবসার জন্য বড়বাজার, একাধিক দর্শনীয় স্থান। তেমন হাতের কাছেই রয়েছে সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং নাখোদা মসজিদের মতো ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থান। আবার গঙ্গা পেরোলেই দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় মঠ। অর্থাৎ মারকুইস স্ট্রিটে থাকলে সব কিছু বাংলাদেশিদের নাগালের মধ্যেই থাকে।
স্বভাবতই এ অঞ্চলের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস বাংলাদেশিরা। তারা না এলে জীবিকা হারাবেন কলকাতার অনেক ব্যবসায়ী। যেমনটা হারিয়েছিল করোনার দুই বছরে। সেই ব্যবসা এখন ধীরে ধীরে জমে উঠছে। সাথে তাদের মনের মধ্যে জমা হয়েছে ভয়ের সঞ্চার। যদি বাংলাদেশিরা এখানে না আসে? ফের যদি স্থান পরিবর্তন করে? যেমনভাবে প্রায় ২০-২৫ বছর আগে নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন জাকারিয়া স্ট্রিট ত্যাগ করেছিলেন তারা। জাকারিয়া স্ট্রিট বড়বাজার সংলগ্ন। তাই সেখানকার স্থানীয়রা ধাক্কা সামলাতে পেরেছেন। কিন্তু মারকুইস স্ট্রিটের গঠন তা নয়। তাই এখানকার স্থানীয় থেকে ব্যবসায়ী সবাই এ ব্যাপারে সচেতন হতে শুরু করেছেন।
সম্প্রতি এখানকার স্থানীয়রা সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য বানিয়ে ফেলেছেন ‘মারকুইস স্ট্রিট/ ফ্যি স্কুল স্ট্রিট রেসিডেন্সিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ওয়েলফেয়ার সোসাইট’ নামে একটি সংগঠন। সেই সংগঠন সম্প্রতি স্থানীয় প্রসাশনগুলোয় চিঠিও দিয়েছে। তাদের অভিমত, চিঠি দেওয়ার পরও তাদের মনমতো সুরাহা হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশিদের রক্ষার্থে এতে কাজ না হলে আগামীতে বৃহত্তর স্তরে প্রশাসনকে জানাতে বাধ্য হবেন তারা, এমনটাই জানায়িছেন ওই সংগঠনের সদস্যরা।
বাংলাদেশিরা সমস্যা পড়া প্রসঙ্গে সংগঠনটি অভিমত, গত কয়েক মাস ধরে ওই এলাকায় বহু বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। বলা যেতে পারে, মারকুইস স্ট্রিট এ বিষয়ে তার চারিত্রিক বদল ঘটাচ্ছে। বিদেশিদের নিরাপত্তার কারণে প্রশাসনের সবচেয়ে নজরদারির এলাকা মারকুইস স্ট্রিটে বাড়ছে ছিনতাই, নারী হয়রানি, নিষিদ্ধ মাদক মাফিয়াচক্র, বিদেশিদের হয়রানি, হুমকি এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারের মতো একাধিক বিষয়।
যাদের দ্বারা বাঙালিরা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা কেউ স্থানীয় নয়। যার কারণে, শান্ত মারকুইস স্ট্রিট অশান্ত হয়ে উঠছে। সংগঠনের সদস্য মো. আলাউদ্দিনের অভিযোগ, নিত্যদিন বাংলাদেশিদের টাকা ছিনতাই, পাসপোর্ট হারানো মতো অভিযোগ জমা পড়ছে স্থানীয় থানায়। এরকম চলতে থাকলে বাংলাদেশিদের মনে মারকুইস স্ট্রিট কালো তালিকায় পড়তে বেশি দিন সময় লাগবে না। বাংলাদেশিরা অনত্র চলে যাবেন। যেমনটা হয়েছে জাকারিয়া স্ট্রিটে। আর এ ঘটনা ঘটলে স্থানীয়রা হারাবেন তাদের জীবিকা।
এ বিষয়ে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের এক সূত্র জানাচ্ছে, এসব খবর তাদের কাছেও আছে। আগে এমনটা হতো না। প্রতি মাসে ৫০-৬০টার বেশি পাসপোর্ট হারাচ্ছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, মারকুইস স্ট্রিটে ব্যাগ ছিনতাইয়ের কারণে টাকা, মোবাইলসহ পাসপোর্ট হারাচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
মিশন আরও জানিয়েছে, এ বিষয়ে তারা লোকাল থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। এমনকি এর প্রতিকার পেতে ভারতের ফরেন রেজিস্ট্রেশন অফিসের (এফআরও) সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? সেখানকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, রাত ১০টার পর এ অঞ্চলে বাড়ছে নতুন হকার। প্রায় সারা রাত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। হাতের সামনে জিনিসপত্র দেখে বাংলাদেশিরাও রাতে কেনাকাটা করছেন। ফলে সুযোগ বুঝে শিকার ঠিক করছে দুষ্কৃতকারীরা। রাতে যখন এভাবে চলছে মাফিয়ারাজ তখন সকালে এই কাজ করছে ভিন এলাকার সাইকেল রিকশা এবং অসংখ্য হোটেল দেখানোর নামে দালালচক্র। তাই দিনের বেলায় টার্গেট করছে কে, কোন মানি এক্সচেঞ্জ থেকে কত টাকা ভাঙাচ্ছে। সংগঠনের অভিমত, হাতে টানা রিকশা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
সংগঠনের অভিযোগ, নতুন হকার, সাইকেল রিকশা, অযাচিত দালালচক্রের কারণে চুরির ঘটনা, নারীদের হয়রানি, ব্যাগ ছিনতাই, মাদকের অপব্যবহার এবং বাঙালিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এলাকায় নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বার বার হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে গোটা মারকুইস স্ট্রিট ও এর সংলগ্ন এলাকা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সংঘবদ্ধভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে জানালে, কিছুদিন পুলিশের তৎপরতা থাকে তখন ওদের তৎপরতা কমে যায়। তারপর আবার একই ঘটনা ঘটে চলে।
তবে এ অঞ্চলে এখনও আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েনি। তাই এ বিষয়ে সিংহভাগ বাঙালি ওয়াকিবহল নয়। তবে সতর্ক থাকার সময় এসেছে বলেই মনে করছে সংগঠনটি। এরকমটা চলতে থাকলে পর্যটকরা মারকুইস স্ট্রিটে আসতে নিরাপদ বোধ করবেন না। সরকার পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য উত্সাহিত করছে, এই শিল্প সরকার এবং দেশের উন্নয়নে অন্যতম রাজস্বেরর যোগান দেয়। এরকম চলতে থাকলে এই এলাকার হাজার হাজার লোক কর্মসংস্থান হারাবে, যার প্রভাব পড়বে পুরো সমাজে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০২৩
ভিএস/এমজেএফ