কলকাতা: ‘অবিনশ্বর’ শব্দের অন্য এক মানে সৃষ্টি হলো কলকাতায়। মৃত্যুর পরেও নিজের অঙ্গ দান করে একাধিক অসুস্থ মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিলেন কলকাতার নাগরিক প্রয়াত শোভনা সরকার (৭১)।
তার কিডনির মাধ্যমে বেঁচে উঠতে চলেছেন দুই মুমূর্ষু ব্যক্তি। ইতিমধ্যেই তার চোখ দুটি প্রতিস্থাপন করা হয়ে গেছে আরো দু’জনের চোখে। লিভার প্রতিস্থাপনের চেষ্টাও চলছে।
গত ২৩ তারিখ ‘ব্রেন ডেথ’ হয় শোভনা সরকারের। এরপর তার পরিবার ঠিক করেন শোভনা সরকারের অঙ্গগুলি দান করা হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তারা চেষ্টা শুরু করেন। বাংলানিউজ এই গোটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল শোভনার পুত্র প্রসেনজিৎ সরকারের সঙ্গে।
মায়ের মৃত্যুর গভীর শোক সামলেও প্রসেনজিৎ সরকার গোটা পক্রিয়াটি বর্ণনা করেছেন। প্রসেনজিতের পিতা শ্রী রবীন্দ্র কুমার সরকারও (৮৪) স্ত্রীর দেহ দান করার বিষয়ে ছিলেন ইতিবাচক।
স্ত্রী বিয়োগের কষ্ট সামলে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথটি রবীন্দ্র কুমারের জন্য সহজ ছিল না। যেমন সহজ ছিল না গ্রহীতা খুঁজে বের করা। শোক বিহ্বল পরিবারের সামনে একদিকে ছিল গভীর শোককে সামাল দেওয়া অন্যদিকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে একাধিক মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর পরিকল্পনা।
শোক সামলে এই পরিবার উঠতে পারেনি ঠিকই কিন্তু শোভনা সরকারের অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হয়ে নতুন জীবন ফিরে পেতে চলেছেন একাধিক মানুষ।
দিন কয়েক আগে দক্ষিণ ভারতে দুর্ঘটনায় মৃত কন্যার অঙ্গ দান করে একাধিক মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে ছিল সেই কন্যার পরিবার। গ্রিন করিডোর তৈরি করে সেই অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কঠিন বিষয়টি রূপ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা এবং প্রশাসন। এরপর কলকাতায় এই ঘটনা মানবতার ইতিহাসে আরও এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
বাংলানিউজকে প্রয়াত শোভনা সরকারের পুত্র প্রসেনজিৎ সরকার জানান, গত ২০ জুন কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতাল ভর্তি হন শোভনা সরকার। ২৩ জুন আইসিসিইউ-তে তার ব্রেন ডেথ হয়। ব্রেন ডেথ হওয়ার ফলে শরীরের অঙ্গগুলি সেই সময় কাজের উপযোগী ছিল। কিন্তু অঙ্গ গ্রহীতা খুঁজে পেতে দরকার ছিল সময়। এই সময়ে তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়।
এর পরেই শুরু হয় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কঠিন লড়াই। যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল দামি। সমস্ত হাসপাতাল, নার্সিং হোমে খোঁজ চালান হয় এমন রোগীদের যাদের অঙ্গগুলি দরকার এবং যাদের শরীরে প্রয়াত শোভনা সরকারের অঙ্গগুলি প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। এর সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকে আইনি কাজকর্মগুলি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার বিষয়টি ছিল এক অসম লড়াই। কখনও মনে হচ্ছিল এই লড়াই তারা জিততে পারবেন, কখনও মনে হচ্ছিল তারা হেরে যাবেন- জানিয়েছেন প্রসেনজিৎ সরকার।
চিকিৎসকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা না থাকলে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা যেত না বলেও জানান তিনি।
অবশেষে জয় হয় শুভ ইচ্ছার। সোমবার (২৭ জুন) বিরলতম ঘটনাটি ঘটে কলকাতায়। প্রথমে চোখ দুটি প্রতিষ্ঠাপিত হয় দুই রোগীর শরীরে। ধীরেধীরে সুস্থ হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন সেই দুজন। তারপর একেএকে কিডনি এবং লিভার। গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে গোটা পক্রিয়া।
কিন্তু কীভাবে এই ভাবনা মাথায় এলো? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রসেনজিৎ বাবু জানিয়েছেন, তার মা সহ পরিবারের একাধিক সদস্যরা দেহদানের ইচ্ছাপত্রে সই
করেছেন। তাই মায়ের ব্রেন ডেথ-এর পর তারা ঠিক করেন অঙ্গগুলি দান করা হবে।
যখন গোটা বিশ্বে বিভিন্নভাবে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে তখন কলকাতার বুকে এ ঘটনা আশার আলো দেখায়। নিজের অঙ্গ দান করে একাধিক মানুষকে চোখের দৃষ্টি এবং জীবন ফিরিয়ে দিলেন কলকাতার প্রয়াত শোভনা ও তার পরিবার। সমাজের কাছে এ এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। মৃত্যুর পরেও এভাবেই এক জীবন থেকে একাধিক জীবনে বেঁচে রইলেন শোভনা সরকার।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫৪ ঘণ্টা, জুন ২৮ , ২০১৬
ভিএস/এমজেএফ/