ইফতার শেষ। বাক্স-পেটরা গোছাতে স্ত্রীকে হাতে হাতে সহযোগিতা।
কিছুদিন আগেই তার আড়াই বছরের একটু বেশী সম্পূর্ণ হয়েছে কলকাতায়। সেই অভিজ্ঞতা কেমন হলো? ছিটমহল বিনিময়, বিবিআইএন চুক্তি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে আগামী ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, তার পরিবারের পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসার ঘটনা, কলকাতায় পিতার মৃত্যু, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।
কলকাতায় আড়াই বছর কাটলো, কেমন হলো অভিজ্ঞতা?
এক কথায় অসাধারণ। বলে শেষ করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আন্তরিকতা এমন, আমি যে দেশের বাইরের, সেটা কোনোদিন অনুভব করতে দেয়নি।
আর দিদির ( মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়) সাথে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা?
দিদির সাথে আমার প্রথম দেখা বারাসাতের যাত্রা উৎসবে। মাত্র কয়েক মিনিটের কথায় আপন করে নিলেন। একটা যাদু আছে ওনার মধ্যে। এরপর থেকে দিদি, যেভাবে আমাকে আপন করে নিয়েছেন সেটা অতুলনীয়। মুখ্যমন্ত্রী একদিন বললেন, জকি তুমি আমার ছোট ভাইয়ের থেকে বেশি।
এবার মুখ খুললেন স্ত্রী লামিয়া রহমান। সেদিন ছিলো আমাদের বিবাহবার্ষিকী। একটি ফটো প্রদর্শনীতে গেছি। কি করে যেনো দিদি জেনে গিয়েছিলেন, আমাদের বিবাহবার্ষিকীর বিষয়টা। প্রকাশ্যে সবার সামনে আমাদের অভিনন্দন জানান তিনি। তারপর অনুষ্ঠান শেষে আমার হাত ধরে একটি শাড়ির দোকানে নিয়ে গিয়ে, নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে শাড়ি কিনে দেন। বলেন, আমি নিজের টাকা দিয়ে কিনে দিলাম। শাড়িটা পরো কিন্তু। সেদিনই আমার দিদির সাথে প্রথম দেখা।
আপনার কার্যকালে তো সাফল্যের একাধিক নজির ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে, ছিটমহল হস্তান্তর, বিবিআইএন চুক্তি, কলকাতা-ঢাকা –আগরতলা বাস সার্ভিস।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলে কিছু সমস্যাও থাকে। সব কিছুই একটা পক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কয়েকটি বিষয় এই পক্রিয়ার মধ্যে বয়েছে।
এবার আসি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি প্রসঙ্গে। সরাসরি জানতে চাইছি এই বিষয়ে আপনি কতোটা আশাবাদী?
দীর্ঘ আটষট্টি বছরে ছিটমহল ছিলো জ্বলন্ত সমস্যা। আজ পৃথিবীর মানচিত্রে ছিটমহল বলে কিছু নেই। তাই তোমার প্রশ্নেও এ নিয়ে কোনও কথা নেই। আজ ছিটমহল শুধুই ইতিহাস। আমি আশাবাদী। একদিন যেভাবেই হোক দুই দেশের মধ্যে তিস্তারও সমাধান হবে।
এই আড়াই বছরে কমিশনের কোনও পরিবর্তন এনেছেন কি?
এনেছি। তবে আমি একা নই। পুরোটাই একটা ‘টিম ওয়ার্ক’। বাংলাদেশের বাইরে কলকাতাই প্রথম কূটনৈতিক ভবন। এই বাড়িটি একটি হেরিটেজ। গোটা বাড়িটি রঙ করা হয়েছে। আমি ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। জানালাগুলোতে আগের মতোই খড়খড়ি লাগানো হয়েছে। ৬৪ বছরে বাড়িটিতে কোন লোগো ছিলো না। শাপলার লোগো লাগানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর নামে রাস্তার ফলকটি আরও পরিষ্কার ও সুন্দর করা হয়েছে, অনলাইন ভিসার ব্যবস্থা হয়েছে, বাইরে ভিসা প্রার্থীদের বসার জায়গা করা হয়েছে, রিসিপশনে বাংলাদেশের আবহাওয়া, প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে শীতলপাটি দিয়ে সাজানো, দূতাবাসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।
ছোটবেলার কোনও অভিজ্ঞতা, যা আপনাকে আজো নাড়া দেয়?
তখন ৫/৭ বছর বয়স। আমার আব্বা তখন পাকিস্তানে ইপিসিএসে কর্মরত। পাকিস্তানে কিছুই বোঝার উপায় ছিলো না, বাংলাদেশে কি ঘটছে। ভরসা শুধু রেডিওতে। কানের কাছে রেডিও নিয়ে আস্তে আস্তে আকাশবাণী চালিয়ে যুদ্ধের খবর শুনতাম। যাতে পাশের কেউ শুনে না ফেলে। ১ মে, আমরা জিবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসি। রীতিমতো পালিয়ে আসি। ছয় সাতটা পাহাড় পেরিয়ে আফগানিস্তান প্রবেশ করি। কিছুটা খচ্চরের পিঠে চড়ে, আর বাকি পথ পায়ে হেঁটে পার হতে হয়েছিল। অবশেষে আমরা পৌঁছেছিলাম আরিয়না এয়ার বেসে। এর পর সেখান থেকে দিল্লি। দিল্লি থেকে কলকাতা। কলকাতায় পার্ক হোটেলে ছিলাম কয়েকটা দিন। পাকিস্তান ছাড়ার ২৫ দিনের মাথায় ২৫ মে (১৯৭৩) নেমেছিলাম তেজগাঁও বিমানবন্দরে।
আব্বা ভেবেছিলেন, সরকারি কাজ আর নেই। কিন্তু তাকে ডেকে নিয়ে এডিসি রেভিনিউর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর বরিশালে ডেপুটি কমিশনার। বাকশালে সরকারি মনোনীত এগারো জনের মধ্যে আব্বা ছিলো সবার কনিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর থেকে আব্বু ছিলেন দশবছরের ছোট। মৌলভী বাজারে বঙ্গবন্ধু আব্বুর হাত ধরে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন ‘এটা আমার বাচ্চা ডিসি’। তিনি যতটা পারতেন আগলে রাখতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। আর কোন সহযোগী সরকার পায়নি আব্বু। আব্বা কোনদিনই সরাসরি কোন রাজনৈতিক দেল সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
বাংলাদেশ নিয়ে কি বলবেন?
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমি গর্বিত যে, আমি বাংলাদেশি। আমি এক কবির জাতীয় সঙ্গীত গাই, আবার আরেক কবি আমাদের জাতীয় কবি। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ে পৌছাতে চাই। ২০৪১-এ উন্নত দেশের নাগরিক হবোই। (চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিলেন)।
আর বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রটা?
আগের থেকে চরম উন্নতি হয়েছে। ব্যবসায়িক, মানসিক, সাংস্কৃতিক, পরিবহন সব দিকেই। আর ইতিহাস কি আমাদের কোনও দিন আলাদা হতে দেবে?
কথায় বলে কূটনীতিকদের নিজের আর পরিবারের জন্য সব থেকে বেশি অভাব থাকে সময়ের। কখনো ক্লান্ত লাগে না?
ক্লান্ত লাগে না তা নয়। কিন্তু যখন ভাবি ৩০ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে আমার দেশ তৈরি হয়েছে, তখন সেই ক্লান্তি চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধ আমার শক্তির উৎস। এরই মাঝে যতটুকু সময় বার করে নেওয়া যায়, সেই সময় হেমন্ত –মান্না- সতীনাথের গান শুনি। আর মাঝে মাঝে আমার পোষ্য মাছগুলোকে দেখি। আর কিছুটা সময় দেই লেখালেথিতে।
এ কবছরে কোথায় কোথায় ঘুরলেন?
চীনে সাড়ে তিন বছর, নেদারল্যান্ডে সাড়ে তিন বছর, ম্যানচেস্টারে সাড়ে তিন বছর, কলকাতায় আড়াই বছর। শুধু পোস্টিংই হলো দেশে দেশে। ঘোরা আর হলো না।
ভাবি আপনার?
অন্যদেশ তো ছাড়ো। ভারত একটা বৈচিত্রময় দেশ। ভেবেছিলাম তোমার দাদা যদি সময় না দেয় একা একাই ঘুরবো মেয়েকে নিয়ে। তা আর হলো কই। এখানে আসার পর বাচ্চাদের পড়াশুনা, তারপর শ্বশুর-শাশুড়ীকে নিয়ে ছিলো ব্যস্ততা। যাওয়ার আগে দেখে গেলাম শুধু দার্জিলিং।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ২০ জুন, ২০১৭
ভিএস/জেডএম