ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত

ভারতে বিপদের অপর নাম ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’, সতর্ক করলেন মোদি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২৪
ভারতে বিপদের অপর নাম ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’, সতর্ক করলেন মোদি প্রতীকী ছবি

কলকাতা: ভারতজুড়ে এখন বিপদের নতুন নাম ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’। অর্থাৎ শারীরিকভাবে নয়, সামজিক মাধ্যমেই গ্রেপ্তার হয়ে যাচ্ছে মানুষ।

 

তবে এই গ্রেপ্তার প্রশাসনের পক্ষ থেকে নয়, এটি একটি সাইবার প্রতারণা। যা এখন বিভিন্ন দেশ হয়ে ভারতেও প্রবেশ করেছে।  

বিষয়টি এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এ বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন।

সচেতন না হলে কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশিরাও বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন।

কীভাবে চলে এই প্রতারণা? কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে  ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ -এর মাধ্যমে কীভাবে প্রতারণা চলছে।  

কলকাতা পুলিশের তথ্য মতে, অনলাইনে পণ্য কেনায় অভ্যস্ত অমিত। হঠাৎ করে তার মোবাইলে মেসেজ আসে যে আপনার ঠিকানা আপডেট না করার জন্য আমরা ডেলিভারি করতে পারছি না। এরপর অমিত ফোন করে কাস্টমার কেয়ারে, নিজের অ্যাড্রেস আপডেট করতে যায়। আপডেট সময় ওটিপি চায় সংস্থাটি। তা দেওয়া মাত্রই অমিত দেখেন, ভারতীয় সামরিক পোশাকে সজ্জিত একদল লোক ভিডিও কলে তাকে জানাচ্ছে যে, আপনি অনলাইন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ড্রাগসের অর্ডার দিয়েছেন। আমরা বহুদিন ধরে আপনার সন্ধানে আছি। আমরা আপনার বাড়ি ট্র্যাক করে ফেলেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পেশাল ফোর্স আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবে।

আচমকা ভিডিও বার্তায় এ ধরনের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান অমিত। কয়েকজন ভারতীয় সামরিক পোশাকধারী, এটা কি শোনালেন?তিনি নাকি ব্রাউন সুগারের অর্ডার দিয়েছেন? ফোনকল কাটার মতো ক্ষমতাও নেই তার। ততক্ষণে সেই শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন অমিত। পরে অমিত তা অস্বীকার করলে ভিডিওর ওপার এমন কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়, যা দেখে মনেই হবে সত্যিই তিনি ড্রাগের অর্ডার দিয়েছিলেন।

মান-সম্মান ও ইজ্জত সব বরবাদ হয়ে যাবে। ফলে করুণ স্বরে তিনি প্রার্থনা করেন, আমি দোষী না হলেও বলুন আমাকে কী করতে হবে। শেষ পর্যন্ত এক লাখ রুপি অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করতে বাধ্য হয়েছিলেন অমিত। এমন তথ্যই পুলিশকে দিয়েছিলেন অমিত।  

অথচ তার নির্দিষ্ট অর্ডার ছিল একটি নামকরা অনলাইন সংস্থার কাছে। কি করে মুহূর্তে তা বদল হয়ে গেল এখনও বুঝতে পারছেন না অমিত। এমনকি উধাও সেই পোশাকধারীরাও।

পরের ঘটনাটাও একই রকম। অনলাইনে পণ্য কেনার পর, কুরিয়ারের ডিটেলস পান প্রিয়াঙ্কা। তারপর একদিন হঠাৎ ফোনে জানানো হয়, ওই কুরিয়ার কোম্পানি থেকে পারসেল ডেলিভারি না হওয়ার জন্য ফোন করা হয়েছে। আপনার বাড়ি আমাদের ডেলিভারি ম্যান খুঁজে পায়নি। তাই আপনি যদি পুনরায় ডেলিভারি চান তাহলে ‘এক’ টিপুন। নিঃসন্দেহে এক টেপার পরে ফোনে আসে একটি ওটিপি। পরিষ্কার ওই কুরিয়ার কোম্পানি থেকে আসা ওটিপি নিঃসংশয়ে শেয়ার করার পর প্রিয়াঙ্কাকে জানানো হয়, বোম্বে ডক ইয়ার্ডে একটি সরকারি সংস্থা তার কুরিয়ার আটক করেছে। কুরিয়ারের মধ্যে ড্রাগস ছিল। মানসিক চাপ দেওয়া শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সমঝোতা করেন ২৫ হাজার রুপিতে নিজের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য।

পরের ঘটনাটি আবার একেবারে ভিন্ন। ফেসবুকে সম্পর্ক। হঠাৎ করে ভিডিও কল আসে রজতের কাছে। এক নারী ভিডিও কল করে কথা বলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পোশাক খুলে উলঙ্গ হয়ে যান এবং বলে এই ভিডিওকলের ছবি ভাইরাল করে দেবে তার পরিচিত মহলে এবং স্ক্রিনশট পাঠাতেও শুরু করে তার বন্ধুবান্ধবদের কাছে। শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার রুপি দিয়ে সেই যাত্রায় রক্ষা পান রজত।

পুলিশ বলছে, এটাই ডিজিটাল অ্যারেস্ট। সচেতন এবং সতর্ক না হলে যে কেউ এই বিপদে পড়তে পারে।  

তথ্য মতে, বহু বাংলাদেশি অ্যামাজন বা ওই ধরনের সাইট দেখে থাকেন। অনেক ক্ষেত্র দেখা গেছে, তারা দেশে বসে ঠিক করেন, কলকাতায় গিয়ে ভারতীয় নম্বর থেকে অর্ডার দিয়ে পণ্যটি হোটেলে সংগ্রহ করবেন। ফলে সচেতন না হলে বিপদ একেবারে আপনার হোটেলের দোরগোড়ায়।

কোভিড পরবর্তী বিশ্বজুড়ে মানুষকে একপ্রকার ‘দাস’ - এ পরিণত করেছে মোবাইল ফোন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই এখন মোবাইলে বন্দি। কারও সময় কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখে, কারও অনলাইনে বিভিন্ন শপিং সাইট সার্ফিং করে। কারও বিভিন্ন অনলাইন সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখে। আবার কারো ফেসবুক, ইন্সটা বা থ্রেডে বন্ধু পাতিয়ে। অথবা টেলিগ্রামে পয়সার হাতছানি, কখনও ক্রিপ্টোকারেন্সি কখনও বিভিন্ন বেটিং বা গেম সাইট থেকে পয়সা রোজগারের হাতছানি। অর্থাৎ মোবাইল নেশায় যারা আসক্ত। তাদের নাড়িনক্ষত্র আগাম সংগ্রহ করে তাদেরকেই টার্গেট করছে প্রতারকরা। আর নতুন কায়দায় অর্থ হাতাচ্ছে তারা।

এই ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ মোবাইলের দুনিয়ার নতুন বিপদ। এখানে আপনার ফোনেই ভিডিও কলের মাধ্যমে আপনাকে আটকে রেখে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করবে প্রতারকরা, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অফিস, সরকারি বিভিন্ন প্রতীক এবং সকালেই নির্দিষ্ট পোশাকে সুসজ্জিত। আপনি বুঝতেই পারবেন না যে এরা আসলে প্রত্যেকেই প্রতারক। সাধারণদের স্বভাবত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’-কে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার কাছে পরিণত করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মানুষকে সাবধান করেছেন এবং ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ সম্পর্কে সচেতন হতে বলেছেন।

তাহলে উপায়? পুলিশ বলছে, ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বলে কোনো শব্দ ভারতীয় আইনে নেই। তাই এ ধরনে ফোন এলে আপনি নিশ্চিত থাকুন, এটা সম্ভব নয়। এরপরেও আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে আপনাকে ওরা ভীত করলেও, আপনাকে চিন্তা করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনোভাবেই ওই চাপের কাছে মাথা না নত করা যাবে না। শুধু ব্যাপক সচেতনতা সমস্ত মোবাইল ফোন গ্রাহকদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারলেই ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ নামক প্রতারণা থামিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আপনাকে মনে রাখতে হবে যা আপনি অর্ডার দেননি বা করেননি তা শত চাপেও স্বীকার করা চলবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২৪
ভিএস/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।