বাংলানিউজ: প্রচলিত আছে, কূটনীতিকদের নিজের আর পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেশি অভাব থাকে সময়ের। কখনও ক্লান্ত লাগে না?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: ১৯৬৮ সালে যখন আমি প্রথম কূটনৈতিক সার্ভিসে যোগ দেই তখন অশান্ত সময় চলছে।
বাংলানিউজ: কর্মজীবনে একজন ডিপ্লোম্যাটেরে একাধিক দেশে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে সন্তানের মানসিক বিকাশ বা শিক্ষার বিকাশে কতটা সমস্যায় হয় কিনা?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: দেখুন, ডিপ্লোম্যাটদের সন্তানদের একটা ভিন্ন নামে ডাকা হয়। যাকে বলা হয় ‘ডিপ কিট’ মানে ডিপ্লোম্যাটিক কিটস। সাধারণভাবেই শিক্ষা জীবনে তার বাবার আটবার বদলি হয় আট জায়গায়। তারা লেখাপড়া করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সিস্টেমে। আমি মনে করি এতে শিক্ষার সঙ্গে মনের বিকাশও ঘটে। গ্লোবালাইজেশনের যুগে তারা একটি কমপ্লিট কম্পোজিট পিকচার পায়। যাকে বলে গ্লোবাল নলেজ।
বাংলানিউজ: ভারতে তিন বছরের বেশি সময় কাটছে, কেমন সে অভিজ্ঞতা?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংহতি ও সম্প্রীতির যে বন্ধন, তা আমি তিন বছর কাছ থেকে দেখেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী আমাদের দু’দেশের সম্পর্ক উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। সম্পর্ক এতোটাই গভীর হয়েছে যে আজ আমাদের দু’দেশের মধ্যে প্রত্যেক বিভাগে সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচন হয়েছে। আমার ভারতে দায়িত্ব থাকার মধ্যে ৬৮ বছরের এক বড় সমস্যা ছিল ছিটমহল। সেই ছিটমহল হস্তান্তরের মতো ঐতিহাসিক বিষয়ের সাক্ষী রয়েছি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর এক দূরদর্শিতার মধ্যদিয়ে ‘ইন্দিরা-মুজিব’ নামে একটা চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয় ২০১৫ সালে। একটা সময় ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে শুধুলেনদেন ছিল ইলিশ আর জামদানির। এখন আর তা নয়। একটা কোয়ালিটি চেঞ্জ হয়েছে। একাধিক বিভাগে আমাদের দু’দেশের মধ্যে একাধিক মউ চুক্তি হয়েছে। আর এই ইতিহাসের সাক্ষী আমি নিজেও। এছাড়া ভারতের সঙ্গে আট প্রতিবেশী দেশ আছে। তারমধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যার সঙ্গে স্থল ও নৌ-সীমানা নিয়ে কোনো বিরোধ নেই।
বাংলানিউজ: আপনি এমন এক রাজ্যের কাছাকাছি আছেন যেখান থেকে গোটা ভারতের নীতিনির্ধারণ হয়। সরাসরি জানতে চাই তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: দেখেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। যেটা ভারতের মধ্যদিয়ে বাহিত হয়ে বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। তিস্তা ৫৪টির মধ্যে একটি নদী। যার জন্ম সিকিমে এবং পশ্চিমবাংলা থেকে বাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যমুনা নদীতে মিলে বঙ্গোপসাগরে তার শেষ হয়। জন্ম ভারতে শেষ বাংলাদেশে। এর মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশ নেই। তাই এটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়। ২০১১ সালের আমাদের দু’পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল। এর খসড়ায় সইও হয়েছিল। সেটা হলো শুষ্ক মৌসুমে কোন রেটে কে কীভাবে পানি শেয়ার করতে পারি। কোন রেটে ভারত পাবে, কোন রেটে বাংলাদেশ পাবে আর কোন রেটে কমন পরিষেবা থাকবে। যাইহোক তখন সে চুক্তিটা সই হয়নি। কারণ পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন ও বর্তমান সরকার সময় চেয়েছিল। আলোচনা চলছে। আমরা তো আশা করি ভারত তার অঙ্গরাজ্য সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনা করলে আমরা সেই আগের চুক্তিতে ফিরে যেতে পারবো এবং তা সমাধান করতে পারবো। তিস্তা নিয়ে যে এখানে মাতামাতি হয় আসলে এখানে আমাদের শুধু ৯০ দিনের জন্য চুক্তি দরকার। ২৭০ বা ২৭৫ দিনের আমাদের মধ্যে চুক্তির কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ঈশ্বর প্রদত্ত যে পানি আমাদের আছে তা যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ঢাকায় গিয়েছিলেন তখন তিনি নিজেও বলেছিলেন তিনটি জিনিসকে কখনই আটকানো যায় না। পানি, পাখি ও বাতাস। তাই পানিকে কখনই আটকাতে পারি না। সিকিমে আমি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাবো, ভারতে আমি সেচপ্রকল্প করবো, তাহলে কিন্তু নদীর গতি সত্যিকার অর্থে কমে যাবে। যে কারণে ফারাক্কা বাঁধ বানানো হয়েছিল। সেই সময় এতো আলোচনা হয়। সেই ফারাক্কা বাঁধ যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল তা একফোঁটা সে কাজের জন্য লাগেনি। সেই বাঁধটা বানানো হয়েছিল কলকাতা বন্দরে অতিরিক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে সেখানে বড় আকারে বন্দর বানানোর জন্য। কিন্তু সেই পানি কলকাতার কোনো কাজে আসেনি। এর একমাত্র কারণ পানি নিয়ে কোনো কাজ করতে হলে বড়ভাবে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন। ছোট আকারের চিন্তা আমাদের বড় ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
বাংলানিউজ: আপনার প্রশ্নের জের ধরে বলি, পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী একটা কথা বারবার বলে আসছেন, আমাকে চাপ কেন? সিকিমে তো ২২টি বাঁধ দেওয়া আছে সেখানে কেন বলছে না।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: দেখুন সিকিমকে কতটা চাপ দেবে আর পশ্চিমবঙ্গকে কতটা চাপ দেবে এটা ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে আমি যতটা জানি সিকিম তার প্রজেক্ট বিদ্যুৎ ব্যবেহারে জন্য করছে। কোনো সেচ প্রকল্পের জন্য নয়। কারণ বিদ্যুতের জন্য পানির গতিপথ বন্ধ হয় না। বন্ধ করে রাখা হয় সেচের কাজের জন্য। কিন্তু তাতেও নদীর কিছুটা গতি কমে। এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বাংলাদেশ সরকার একমত। এবার কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারদের সঙ্গে কি আলাপ-আলোচনা করবে সেটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যাপার।
বাংলানিউজ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশের আমূল অগ্রগতি নিয়ে কি বলবেন?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ অনেকটাই বেড়েছে। হিউম্যান রিসোর্চ ডেভেলপমেন্টও অত্যাধিক ভালো। আমি মনে করি সেদিক থেকে শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির কারণে তা সম্ভব হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, সামাজিক ও বৈদেশিক রাজনীতিরও উন্নতিও হয়েছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর।
বাংলানিউজ: কলকাতা ছাড়া ভারতের অন্য অংশের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের বিষয়ে কি পরিকল্পনা রয়েছে?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: নিশ্চই তুলে ধরা হচ্ছে অন্য অংশেও। ভারতে আমাদের সব মিলিয়ে বর্তমানে একটি দূতাবাস ও চারটি উপ-দূতাবাস রয়েছে। দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা, মুম্বাই ও গৌহাটিতে। এরমধ্যে ভারতে আমদের আরও একটি দূতাবাস খোলার পরিকল্পনা রয়েছে এবং অচিরেই তা হবে। বিভিন্ন অঞ্চলে দূতাবাস করার কারণ দু’টি, এক ভিসা প্রক্রিয়া বাড়ানো, যা আমি বড় আকারে প্রজেক্ট নিয়েছি এবং তাতে ভারতবাসী সহজে ভিসা পাচ্ছে। এবং বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের অন্য রাজ্যেও তুলে ধরা।
বাংলানিউজ: ভারতে বাংলাদেশিরা দুই কারণে বেশি আসে। এক চিকিৎসা, দুই ভ্রমণ। এখানে দু’দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিসা পদ্ধতি আরও সরলীকরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আগামী দিনে আছে কি?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: ভিসা পদ্ধতি আগের থেকে অনেকটাই সরলীকরণ হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। সরকারি অফিসার পাসপোর্ট হোল্ডারদের ভিসা প্রসেস উঠে গেছে। ১৪ দিনের জন্য একে অপরের দেশে ভিসা ছাড়াই আসতে পারছে। ৬৫ সালের উপরে যারা আছেন ও ব্যবসায়ীদের জন্য ৫ বছরের ভিসা দেওয়া হচ্ছে এবং চিকিৎসার জন্য রোগীর সাসঙ্গে দু’জন করে আসতে পারছেন। ভিসার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। এন্ড টু এন্ড মৈত্রী এক্সপ্রেস হয়েছে। এখন তো কলকাতা থেকে মৈত্রীর টিকিট পাওয়াই মুশকিল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন ৬৫ সালের আগে যে ক’টা রেল যোগাযোগ ছিল তা পুনর্জীবিত হবে। আমি মনে করি দু-একটা প্রজেক্ট বাকি আছে সেগুলোও শেষ হয়ে যাবে। কাজেই আমি বলতে চাই দু’দেশের পিপল টু পিপল মুভমেন্ট বাড়ানোর যে লক্ষ্য আমরা নিয়েছি তার মধ্যে ভিসাহীন যাতায়াতের একটা পরিকল্পনার কাজও চলছে।
বাংলানিউজ: একটা সময় বাংলাদেশিদের ভারতীয় ভ্রমণ ভিসা পেতে যথেষ্ট হয়রানি হতো। তবে তাদের যতদিনই ভিসার মেয়াদ দেওয়া হোক না কেন সেই ভিসা কিন্তু মাল্টিপল হতো। অপরদিকে ভিসা বিষয়ে একাধিক অভিযোগ রয়েছে কলকাতার উপ-দূতাবাসে। তার মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়ী ছাড়া মাল্টিপল ভিসা সহজে কেউ পায় না এবং ৩০ থেকে ৯০ দিন ভিসার মেয়াদ যাই থাকুক না কেন, তাও সিঙ্গেল এন্ট্রি। কেনো এই সমস্যা?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: দিল্লি থেকে এই সমস্যাটা এখনও হয়নি। আমরা দিয়ে দিচ্ছি। অন্য উপ-দূতাবাস থেকে এখনও সেরকম অভিযোগ আসেনি। আমি মনে করি কলকাতায় ভিসা বিষয়ক চাপটা বেশি। তবে আপনি যখন বলছেন আমি খোঁজ নেবো এবং কোনো সমস্যা থাকলে তা মিটে যাবে।
বাংলানিউজ: সড়কপথ, রেলপথ এবং আকাশপথে সাফল্যের সঙ্গে দু’দেশের মধ্যে যাত্রী পরিষেবা আছে। নদীপথ আমরা কবে পেতে পারি?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: নদীপথ দিয়েই কিন্তু একসময় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা হতো। এখন নৌপথে যোগাযোগের কথা বলতে গেলে আপনাকে নদীর কথা ভাবতে হবে। অধিকাংশে নদীর গভীরতা কমে গেছে। তার কারণ নদীগুলোর ঠিকমতো যত্ন নিতে পারিনি আমরা। আমরাও চাই নদীগুলো বাঁচিয়ে তুলতে। নদীগুলো আমাদের ‘মা’। তাই বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের যৌথভাবে আরও কাজ করতে হবে।
বাংলানিউজ: আসামে ৭০ শতাংশ বাঙালি সমস্যায় পড়েছে। তার একমাত্র কারণে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারী, কি বলবেন?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী: এখন পর্যন্ত এটা ভারতের একটা রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তবে এটা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। আমরাও গোটা বিষয়টার উপর লক্ষ্য রেখেছি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে যদি কিছু বলে তখন আমরা আমাদের তরফ থেকে উত্তর দেবো।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে বাংলানিউজ ও তার পাঠকদের সময় দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৮
ভিএস/এএ