কিছুক্ষণ আগেই মধ্য কলকাতার একটা ঝকঝকে হোটেল দেখে দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছি। মেনু আহামরি কিছু নয়।
রাতেও তেমনি আপ্যায়নের হ্যাঁপায় পড়েছিলাম। হাতিবাগানের মুখে যে হোটেলে খেতে ঢুকেছিলাম, সেখানে চিংড়ির মালাইকারি আর পটল ভাজা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পাতে সর্ষে ইলিশ চলে এলো। বয় ছেলেটি চটপটে। জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকাতেই উত্তর পাই,‘বাঙালি হোটেলে খেতে এসেছেন দাদা, ইলিশ ছাড়া কী হয়!’
একটানা পছন্দের খাবার খেয়ে শরীর ও মেজাজ ফুরফুরে লাগছে। গঙ্গার তীরে বাবুঘাটে কাজ সেরে আমি যাবো তিলজলা-পিকনিক গার্ডেনের দিকে। অনেকটা দূরের পথ। যেতে হবে বালিগঞ্জ কিংবা পার্ক সার্কাস পেরিয়ে একেবারে বাইপাসের আগে আগে।
২০১৭ সালের বর্ষাকালে কলকাতা ভ্রমণের সময়টায় আমি ছিলাম দৌড়ের উপর। আগের দিন দুপুরে দমদম বিমানবন্দরে নেমে উত্তর কলকাতার বেলঘরিয়ায় কাটিয়ে সন্ধ্যা পার করেছি শহরের কেন্দ্রস্থলের কলেজ স্ট্রিট, গিরিশ পার্ক, হেঁদুয়ার দিকটায়। যার অতিথি হয়েছি, তিনি ব্যাচেলর। পারতপক্ষে ঘরে রান্নার ঝামেলা করেন না। ফলে রাতের খাবার হাতিবাগানের এক হোটেলে খেয়ে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা থেকে বি.টি.রোড ধরে ফের উত্তরে যাত্রা করে সোজা দক্ষিণেশ্বরে তাঁর বাড়ি।
ভোরে ছুট লাগিয়েছি কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ। প্রাতঃরাশের আমন্ত্রণ ছিল গড়িয়ায়। সেখান থেকে বাঁশদ্রোণী আর টালিগঞ্জে ছোট্ট দু’টি কাজ সারতে সারতে দুপুর। তারপর মধ্য কলকাতা। চৌরঙ্গীর আশপাশটায ঢুঁ মারতেই মনে পড়লো, আপাতত আমাকে পাশেই গঙ্গাতীরের বাবুঘাটে যেতে হবে। ওপারে হাওড়া থেকে কয়েকজন দেখা করতে আসবেন। ভিড় এড়িয়ে সহজে আসার জন্য তাঁরা ব্যবহার করবেন নদীপথ। দুপুরের খাবার সেরে ধীরে-সুস্থে অফিসপাড়া-হাইকোর্ট পেরিয়ে বাবুঘাটে এসেছি তাদের জলযান আসার অপেক্ষায়।
নদীতীরে যেতে বড় রাস্তা থেকে চক্ররেলের লাইন পেরিয়ে জেটির মতো যাত্রী পারাপারের লম্বা একটা পুল। নদীবক্ষে ঝুলন্ত পুলটিতে হাঁটাহাঁটি করে বেশ লাগলো। কলকাতা শহরটির যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রকৃতই বহুমুখী--রেল, সড়ক, ট্রাম, মেট্রো, নদী, সব দিক দিয়েই নাগরিকদের টেনে নিচ্ছে।
হাঁটাহাটি শেষে এক সময় বসে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছি, ঔপনিবেশিক কলকাতা-ছোঁয়া গঙ্গার পাড়ে তৈরি হয়েছে কত ঘাট আর সেসব ঘাট ঘিরে রয়েছে কত-শত কাহিনি! নামের বাহারের মতোই ঘাটেরও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। আউটরামের ঘাট, প্রিন্সেপ ঘাট, নিমতলী ঘাট কত কি নাম! কোনও ঘাটে হয়ত কেবলই ভ্রমণ। কোনটি যাতায়াতের। আবার কোনটি ধর্মাচরণের এবং কোনটি ব্যবসায়িক মালামাল ওঠা-নামার।
ঘাটগুলোর ইতিহাসও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাবুঘাটের কথাই ধরা যাক। ঘাটটি একদা ছিল ডিহি কলকাতার সর্বদক্ষিণ প্রান্ত। কলকাতার ইতিহাসে জানবাজার এলাকার রানি রাসমণির নাম ও অবদান সুবিদিত। তাঁর নামে বড় এভিনিউ ও পার্ক রয়েছে। ধর্মতলার সামনে ঐতিহ্যবাহী কার্জন পার্কটি এখন যতদূর জানি রানি রাসমণির নামে করা হয়েছে। বেলুড় মঠ আর দক্ষিণেশ্বরের মাঝামাঝি স্থানে গঙ্গার পাড়ে ‘লোকমাতা রানি রাসমণি মন্দির’ আছে। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রানি দানশীলতা ও ধর্মপরায়ণতার জন্য খ্যাত।
রানি রাসমণি তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র দাসের নামে ঘাটটি নির্মাণ করেন উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গঙ্গার প্রয়োজনীয়তা অপরিহায। পূণ্যার্থে নিত্য গঙ্গাস্নান করারও রেওয়াজ আছে। । সে আমলে ঘাট না থাকায় মানুষের অশেষ কষ্ট হতো।
বাবুঘাট নির্মিত হলে ধর্মভীরু মানুষেরই শুধু উপকার হয়নি, যাতায়াতেরও বিশেষ সুবিধা হয়। তবে প্রাচীন ঘাট ও প্যাভিলিয়ন অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। তুলনায় লঞ্চঘাটটি জমজমাট। জেটির এক পাশে মাটির ভাঁড়ে মেদিনীপুরের মাঝবয়েসী যে লোকটি চা বিক্রি করছেন, তিনি আমার হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিব্যি ইতিহাসের বিবরণ বলে গেলেন, ‘রাজাবাবুর অত বড় নাম কে আর কষ্ট করে কইবে বলুন? সবাই বাবুঘাটই বলে। ’
'বাবুঘাট' নামটির নিচে চাপা পড়ে গেল খোদ রাজাবাবুর নাম!
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৮
এমপি/জেএম