অপরদিকে ভারতের বহু ব্যবসায়ী মুক্তিযুদ্ধকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। যার কথা বলছি, তিনি ছিলেন সেই সময়ে নবীন ব্যবসায়ী।
গিয়েছিলাম অন্য ধরনের সংবাদ সংগ্রহ করতে। কলকাতার মাটিতে নীহারবাবু এমন এক ব্যক্তিত্ব যার বাড়িতে নিছক সময় কাটাতে আসতেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন বা বলা যেতে পারে আজও আসেন শঙ্খ ঘোষের মত ব্যক্তিরা।
পশ্চিমবাংলায় তখন তরুণ তাজা প্রাণগুলো নকশালবাড়ির বিপ্লবের ডাকে টগবগ করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এই গান্ধী পরিবারের সঙ্গে নীহাররঞ্জন চক্রবর্তীর যোগাযোগ ও হৃদ্যতা এতোটাই গভীর ছিল যে, দিল্লি থেকে সে সময়ে কোনো নেতা বা আমলা কলকাতায় এলে তাঁর বাড়িতেই উঠতেন। এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বা তৎকালীন পশ্চিমবাংলার দাপুটে নেতা বরকত গনি খান চৌধুরীর মত ব্যক্তিত্বরা ছিলেন নীহারবাবুর অতি ঘনিষ্ঠ।
আমাদের খবর সংগ্রহের বিষয় ছিল নকশালবাড়ির আন্দোলন ও কংগ্রেসের নেতাদের সাথে নীহাররঞ্জন চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু ৯৪ বছর বয়সী নীহারবাবু যখন তাঁর স্মৃতিকথা বলতে শুরু করলেন,তখন আমাদের না জানা অনেক কথাই বেরিয়ে আসছিল তাঁর মনের মনিকোঠা থেকে। আমি মোটেও ইতিহাসের ভাল ছাত্র নই। মন দিয়ে শুনছিলাম বয়সের ভারে খেই হারিয়ে যাওয়া তাঁর কথাগুলো। তাঁর কথার মাঝেই প্রশ্ন করলাম, ‘সেই সময়ের বাংলাদেশের কথা কিছু মনে আছে?’
নিমেষে বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল তার ঘোলা চোখে। বললেন, কেন থাকবে না? আমি নিজে তো ওখানকার লোক। আমার বাড়ি ছিল বরিশালে। ব্যবসার কারণে কলকাতায় আমার স্থায়ী বসবাস। তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি। অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি ওখানে কিছু একটা হতে পারে বা হতে যাচ্ছে। একটা পরিবর্তন আসছে বাংলাদেশে। অনুশীলন সমিতির মহারাজ ত্রিলোকেশ্বর চক্রবর্তী ইঙ্গিত দিয়েছিল এ বিষয়ে, এবং সেটা তিনি ইন্দিরা গান্ধীকেও বলেছিলেন। কিন্তু তারপরেই তিনি মারা যান। আমি মিট করেছিলাম তার সাথে। আমি একসময় অনুশীলন সমিতি করতাম। এরপর মুজিবের ডাকে যখন মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল তখন আমি নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতাম। আমার অনেক বন্ধু ছিল ওখানে।
অমিয় বসু ছিলেন বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট। অনেক ভুমিকা ছিল তাঁর। বিখ্যাত সংবাদিক গৌরী ঘোষ ও আরেক অ্যানাস্থেটিস্ট ডাক্তার বিমল ঘোষ ওরা দুজন ভেতরে যেত। ওপারে একজন ডাক্তার ছিল যতদূর মনে পড়ে তার নাম আসাবুল হক। তিনিও বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন। উনি ছিলেন কুষ্টিয়ার লিডার। তখন কুষ্টিয়ার সাথে কলকাতা থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যেত। নিয়মিত দুজনে ভেতরে গিয়ে কুষ্টিয়ার সেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতো। আমরা রাত জেগে অপেক্ষা করতাম অমিয় বসুর বাড়িতে। তারা ফিরে এসে কি বলে শুনব।
যখন তাজউদ্দীন আহমেদ নিজ বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে যান, বুঝতে পারছিলাম আরও বড় কিছু একটা হতে চলেছে। গোলক মজুমদার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ও ছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক। গোলক একদিন রাতে আমায় ফোন করে। বলে নীহার খাবারের ব্যবস্থা কর। আর আমার বাড়ি চলে আয়। আমি গেলাম। দুই লিডার এসেছে ওপার থেকে। তাজউদ্দীন আহমেদ আর ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম।
আমি বাবুর্চিকে ফোন করলাম। সে জানায় চার পাঁচ জনের খাবার সার্ভ করা যাবে। সেদিন কিছু একটা ছিল বাজার-টাজার বন্ধ ছিল। মনে হয় হরতাল বা বনধ ছিল। আমার আরেক বন্ধু বিখ্যাত শিল্পী, ঠাকুরবাড়ির শুভ ঠাকুরকে বললাম গোলকের বাড়িতে কয়েকজন অতিথি এসেছে। কি কারণ আমি বলিনি। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে বললো চিন্তা কোরো না তুমি গাড়িটা দাও আর টাকা দাও আমি বাজার করে আনছি।
তাজউদ্দীন আহমেদ আর আমীর উল ইসলাম টানা ছয়দিন পায়ে হেঁটে ফরিদপুর, কুষ্টিয়ার পথ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত হয়ে কলকাতায় এসেছিন গোলকের বাড়িতে। তারপর ওদের নিয়ে যাওয়া হয় শেক্সপিয়ার সরণিতে। এখন যেটা অরবিন্দ ভবন। আমীর উল বলছিল ছয় দিন কাপড় পাল্টাইনি। গা দিয়ে গন্ধ ছাড়ছে। গোসল করব আগে। এরপর তাদের জামা কাপড় জোগাড় করলাম। মনে আছে আর একজনের নাম। কে এফ রুস্তম। তিনি ছিলেন বিএসএফের প্রধান। তারপর ওদের দিল্লি নিয়ে যায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মিটিং করাতে। তাজউদ্দীন আহমেদ খুব বড় মাপের লিডার ছিলেন।
গোলক বলল নীহার অনেকগুলো গাড়ি লাগবে। সরকারীভাবে এ গাড়ি দেওয়া যাবে না। আমার ছয়টা গাড়ি ছিল। তারপর ভাবলাম আমার ড্রাইভারের মধ্যে অবাঙালী মুসলমান আছে। তখন কলকাতায় পাক গুপ্তচরে ভর্তি। সিআইয়ের এজেন্টে ভর্তি। এখানে তখন পাকিস্তান দূতাবাস। হোসেন আলি দায়িত্বে ছিল। হোসেনও আমার পরিচিত ছিল। হোসেন ডেকেছিল আমায়। ওরা যতোদিন কলকাতায় ছিল আমি দেখা করিনি। এরপর বড়বাজার থেকে কুড়িটা গাড়ি ভাড়া নিই। তখন শুধু অ্যাম্বাসাডার ভাড়া পাওয়া যেত। প্রশ্ন ছিল, এসবের টাকা কে জোগান দিচ্ছিল? কে জোগান দেবে। আমি। তখন বিশাল কাজ হতে চলেছে। ওপারে সরকার গঠন হবে। এত সব ভাবলে কী আর হয়!আর বেশি তো নেয়নি। সেসময় ১শ থেকে ১শ বিশ টাকা দিলে সারাদিন গাড়ি রেখে দেওয়া যেত।
মনে মনে অঙ্ক কষছিলাম সত্তরের দশকে দুই হাজার রুপি! আমি শুনছি আর অবাক হচ্ছি। এ ইতিহাস তো আমার জানা ছিল না।
নীহারবাবু বলে চললেন: অন্ধকার থাকতেই প্রেসক্লাব থেকে সবাই রওনা দিই। গোলক বলল উঠে পড় আর দেরি করিসনে। আমি বললাম, তোরা এগো। আরও কয়েকজন সাংবাদিক আসবে তাদের নিয়ে রওনা দিচ্ছি। পৌছে আমি অবাক। খুব সুন্দর জায়গাটা বেছেছে শপথ নেওয়ার জন্য। চারিদিকে আম গাছে ভর্তি। অদ্ভুত অসাধারণ!
এবার আর থাকতে পারলাম না। নীহারবাবুকে বললাম, কিছু ছবি আছে বা নথি আছে, যাতে বিষয়গুলোতে আপনি জড়িত ছিলেন বুঝব?
বললেন ছবি যা ছিল দিয়ে দিয়েছি। কিছু ওপারে আর কিছু আমাদের দুই মিউজিয়ামকে। আর কিছু পাবার আশাই করিনি। টাকার অভাব আমার আজও নেই। বিয়ে করিনি। কী হবে এসবে!
ভাবছি এ বিষয় তো আগে শুনিনি। সত্যি হলে এটা ইতিহাস হবে। হঠাৎ তার দরজায় ঠক ঠক। তার ভাগ্নে দরজা খুলতেই আমি অবাক। সশরীরে দাড়িয়ে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম। এসেই নীহারবাবুকে দাদা বলে জড়িয়ে ধরলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৮
ভিএস/জেএম