দুই বছরের রিজওয়ান আলী তার বয়সী যে কোনো শিশুর মতোই অবিরাম দৌঁড়ে বেড়ায় তার বারাসতের বাড়িতে। কিন্তু তাকে হেসে খেলে বেড়াতে দেখে তার মা অবাক হয়ে যান।
১ বছর পরে আগে ভারতে প্রতিস্থাপিত লিভারের কনিষ্ঠতম জীবিত গ্রহীতা এই শিশুটি দারুণ চনমনে হয়ে উঠেছে। শুক্রবার অ্যাপোলোতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রিজওয়ানই ছিল সবার নয়নের মণি। ওকে এক দণ্ড বসিয়ে রাখা যাচ্ছিল না।
এই দিনই অ্যাপোলো গ্লেনইগলস পূর্ব ভারতের কোনো হাসপাতালের প্রথম একক লিভার প্রতিস্থাপন ইউনিট চালু করল। ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. রামদীপ রায়ের নেতৃত্বাধীন এই দলে থাকছেন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দুই ডাক্তার- ডা. সুমিত গুলাটি আর ডা. সুপ্রিয় ঘটক।
রিজওয়ানের একটা জন্মগত সমস্যা ছিল, যার নাম এক্সট্রা হেপাটিক বাইলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়া। এই সমস্যা থাকলে লিভারে তৈরি হওয়া পিত্ত অন্ত্রে পৌঁছায় না, কারণ পিত্তনালী অনুপস্থিত। এর ফলে ক্রমশ লিভারের অপূরণীয় ক্ষতি হতে থাকে, তারপর ইনফ্যান্টাইল সিরোসিস অফ লিভার হয়। রিজওয়ানকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় ছিল লিভার প্রতিস্থাপন।
এ কথা জানার পর রিজওয়ানের মা রিনা বিবি চোখের পলকে সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে নতুন জীবন দিতে তিনি নিজের লিভার দান করবেন। রিনা গৃহবধূ, আর তার স্বামী সবজি বিক্রেতা। রিজওয়ানের এক দিদিও আছে।
রিনা বিবি বলেন, অপারেশনের আগে আমার ছেলের প্রস্রাব ছিল গাঢ় হলুদ আর পায়খানা সাদা। সারাক্ষণ কাঁদত আর একদম ঘুমোতে পারত না। আমরা যখন জানলাম ওর অসুখটা কী, তখন ভেবেছিলাম ওকে আর রাখতে পারব না।
‘ভাগ্যিস অপারেশনটা করাব ঠিক করেছিলাম, এখন তো আমার ছেলে পুরোপুরি সেরে উঠেছে’ যোগ করেন তিনি।
পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ডা. শুভময় দাস জানান, ‘বাবা-মায়েদের বাইলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়ার লক্ষণগুলো চিনতে পারা খুব জরুরি। এর মধ্যে গাঢ় হলুদ প্রস্রাব আর ফ্যাকাশে পায়খানাও পড়ে। যত তাড়াতাড়ি অসুখটা ধরা পড়ে, ফলাফল তত ভাল হয়।
‘এই বাচ্চাটাকে যখন আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন ওর মরো মরো অবস্থা। এরপরেও আমি ছেলেটার মায়ের প্রশংসা করি, কারণ উনি একেবারে সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ দাতা হতে রাজি হয়েছিলেন। ’
তিনি বলেন, অসুখটা ধরতে পারা বেশ কঠিন। কারণ লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে বাচ্চাদের যখন কয়েক মাস বয়স সেই সময়। ঐ বয়সে বাচ্চারা নিজেদের অসুবিধা বোঝাতে পারে না, ফলে অনেক বাবা-মায়েরাই বাচ্চার কান্নার কারণ যে কোনো ব্যথা, সেটা বুঝে উঠতে পারেন না।
প্রতিস্থাপনের পর রিজওয়ানের ফুসফুসে একটা ভাইরাল ইনফেকশন হয়েছিল এবং তার অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছিল। কিন্তু অ্যাপোলো গ্লেনইগলসের এক মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ডাক্তারদের টিম তাকে সারিয়ে তোলে।
অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতালের ইন্সটিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোসাইন্সেজ অ্যান্ড লিভারের ডিরেক্টর ডা. মহেশ কুমার গোয়েঙ্কা বলেন, বিভিন্ন বয়সের বহু মানুষ নানা অসুখের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। তাদের কাছে লিভার প্রতিস্থাপন হল শেষ আশা। যদিও অ্যাপোলো গ্লেনইগলসে আমরা বহু বছর ধরেই লিভার প্রতিস্থাপন করছি, এই মুহূর্তে দরকার এক টিম সার্জন যারা এককভাবে লিভার প্রতিস্থাপনই করবেন।
আমি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, এখন আমাদের একটা অসামান্য প্রতিভাবান টিম রয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন ডা. রামদীপ রায়। ডা. সুমিত গুলাটি আর ডা. সুপ্রিয় ঘটক তার সাথে দারুণ সঙ্গত করেন। আমরা ভাগ্যবান যে এদের সঙ্গে আছেন অত্যন্ত প্রতিভাবান জি আই লিভার প্রতিস্থাপন ইনটেসিভিস্ট ডা. ইন্দ্রজিৎ তিওয়ারি।
অ্যাপোলো হাসপাতাল গ্রুপের সিইও (ইস্টার্ন রিজিয়ন) রাণা দাশগুপ্ত বলেন, আমরা সবসময়েই আমাদের রোগীদের সেরা পরিষেবা দিতে সাধ্যাতীত চেষ্টা করি। আর ডাক্তারদের পারদর্শিতা সেই চেষ্টা সফল করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. মহেশ গোয়েঙ্কা আর তার ক্রিটিকাল কেয়ার টিম বহুদিন ধরে অসাধারণ কাজ করে চলেছেন। ডা. রামদীপ রায়ের অধীন অ্যাপোলো গ্লেনইগলসের প্রথম ইন-হাউস একক লিভার প্রতিস্থাপন টিম (পূর্ব ভারতের যে কোন হাসপাতালেরই প্রথম) আমাদের মুকুটে আরেকটা পালক যোগ করল। আমি নিশ্চিত এই টিম আগামীদিনে আমাদের অনেক সম্মান এনে দেবে।
অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতালের লিভার প্রতিস্থাপন এবং হেপাটো-প্যানক্রিয়েটিকো-বাইলিয়ারি (এইচ পি বি) সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. রামদীপ রায় বলেন অ্যাপোলো গ্লেনইগলস হাসপাতালের ইনস্টিটিউট ইফ গ্যাস্ট্রো সাইন্সেজ অ্যান্ড লিভারের অধীনে একটা নতুন টিম তৈরি করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
তিনি বলেন, দিল্লী-গুরগাঁও অঞ্চলে একটা লিভার প্রতিস্থাপন টিমকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর আমার নিজের শহর কলকাতায় ফিরে এসে আরেকটা লিভার প্রতিস্থাপন প্রোগ্রাম তৈরি করতে পেরেছি ভেবে ভাল লাগছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০
এমআর/টিসি