ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

অনলাইন মিডিয়ার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে মানুষ প্রযুক্তিপ্রেমী: মুক্তাদির

মনোয়ারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১২
অনলাইন মিডিয়ার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে মানুষ প্রযুক্তিপ্রেমী: মুক্তাদির

ঢাকা: অনলাইন মিডিয়ার জনপ্রিয়তাই এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রযুক্তিপ্রেমের জানান দিচ্ছে বলে মনে করছেন এশিয়ার সর্ববৃহৎ কম্পিউটার মার্কেট হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত বিসিএস কম্পিউটার সিটির সাধারণ সম্পাদক এএসএম আবদুল মুক্তাদির।

সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকালে তিনি এ অভিমত তুলে ধরেন।



এ সময় কম্পিউটার সিটির নানা দিক, বর্তমান কম্পিউটার মার্কেট, কম্পিউটারের চাহিদা, আগামীর প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি জগতের বেশকিছু বিষয় নিয়ে খোলামেলা  কথা বলেন প্রযুক্তিপণ্য প্রতিষ্ঠান নেটস্টার প্রা. লিমিটেডের এই উদ্যোক্তা।

আবদুল মুক্তাদির বলেন, “দেশে প্রযুক্তিপণ্যের বিকাশ ও সম্প্রসারণ, তৃণমূল পর্যায়ে তা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে বিসিএস কম্পিউটার সিটি। একইসঙ্গে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে এই বৃহত্তম কম্পিউটার মার্কেট। ”

“আমাদের এখানে ক্রেতার সর্বোচ্চ স্বার্থ দেখা হয়” দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা এখানে মানসম্পন্ন পণ্য আমদানি নিশ্চিত করেছি। সেই সঙ্গে কোনভাবেই যেন ক্রেতার স্বার্থ বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমরা সচেষ্ট থাকি। ”

এএসএম আবদুল মুক্তাদির বলেন, “আমাদের এই মার্কেট দেশের কম্পিউটারের চাহিদার অনেকটাই পূরণ করে। ঢাকায় কম্পিউটারের অন্যান্য মার্কেট থাকলেও সেখানে নানারকম দোকান থাকে। কিন্ত আমাদের এ মার্কেটে শুধূই কম্পিউটার বিক্রি করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, এ মার্কেট নিয়ে আমরা আরও এগিয়ে যাবো। সেই সঙ্গে দেশের প্রযুক্তিমনস্ক মানুষ এগিয়ে যাবে। ”

তিনি বলেন, “একসময় দেখা যাবে ঈদে কাপড়ের দোকানে যেমন ভিড় হয় কম্পিউটারের দোকানেও তেমন ভিড় হবে। মানুষ নিজেকে এগিয়ে রাখার জন্য কম্পিউটারে আরও অভ্যস্ত হবে। আপনারা জানেন যে, গ্রামের ছাত্রছাত্রীরাও এখন কম্পিউটারের কেনার কথা ভাবে। কারণ, এর প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছে। ”

তিনি বলেন, “অনেক মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার না করলেও এর গুরুত্ব সম্বন্ধে জানে। এখন কম্পিউটার আর কারও কাছে অপরিচিত কোন বিষয় নয়। তবে একটা কথা বলতেই হবে, সাধারণ মানুষ তাদের চিন্তার মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশকে নিয়ে নিয়েছে। তাই প্রযুক্তি সেক্টর, অনলাইন সেক্টর বা তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। ”

অনলাইন মিডিয়া বা বিভিন্ন সামাজিক সাইটের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অনলাইন মিডিয়া বা আউটসোর্সিংয়ের জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ প্রযুক্তিপ্রেমী। এখন অনেক অনলাইন পত্রিকা হয়েছে। আগামীতে হবে। অনেকের পাঠক সংখ্যা সাধারণ মানের পত্রিকার থেকে বেশি। মানুষ ব্লগে লিখছে, ফেসবুকে সব কথা প্রকাশ করছে, একটা আলাদা জগতে বাস করছে। । সবমিলিয়ে আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। এখন সবকিছু অনলাইনে হচ্ছে। কেনাকাটা, লেনদেন, যোগাযোগ সবকিছুই । অনলাইনে না থাকা মানে অফ থাকা। সবার হাতে স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকে, ফলে জীবনযাত্রার প্রযুক্তির প্রভাব স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। এটা বলা যায়, আগামীর ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তিপণ্যই নেতৃত্ব দেবে। ”   

সাম্প্রতিক বিষয়ে তিনি বলেন, “ঈদে প্রিয়জনকে কম্পিউটার উপহার দিন’ এ স্লোগানে এবার ঈদে ‘ঈদ ফ্যাস্টিভ্যাল ২০১২’ এর আয়োজন করেছিলাম। আমরা চাই শুধু জামাকাপড় বা জুতা নয়, মানুষ ঈদে আরও বেশি বেশি কম্পিউটার কিনতে অভ্যস্ত হোক। ”

তিনি বলেন, “মানুষকে আমরা প্রযুক্তিপণ্যের ব্যপারে অনেক বেশি আগ্রহী করতে চাই। এজন্য আমাদের  প্রযুক্তিকেন্দ্রিক উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত। আমরা সিটি আইটি ফেয়ারসহ নানা সময়ে নানা আয়োজন করে থাকি। এখন প্রিয়জনকে প্রযুক্তিপণ্য উপহার দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। এ ধারাকে আরও সক্রিয় করতে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আয়োজন করবো। ”

আফসোস করে মুক্তাদির বলেন, “আমরা সফটওয়্যার শিল্পে কিছুটা এগিয়ে গেলেও হার্ডওয়্যার তৈরিতে একেবারে পিছিয়ে। তবে আমরা আশাবাদী থাকতে চাই । বাজারে চাহিদার কারণে আগামীতে বিশ্বের নামিদামি সব ব্র্যান্ড হয়তো বাংলাদেশে তাদের কারখানা দেবে। যেমনটি হয়েছে চীনে। তখন এসব পণ্যের দাম আরও কমবে। প্রযুক্তির বাজারে সেই দিন বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা এভাবে অব্যাহত থাকলে এটা কঠিন কিছু নয়। ”

প্রযুক্তিশিক্ষা নিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ। কিন্ত পৃষ্ঠপোষকতা কম। সরকারকে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কোর্সে বিভিন্ন প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করে থাকে। শুধু তাই নয়, তাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তৈরি প্রকল্পগুলোর বাণিজ্যিকায়নের দায়িত্ব নিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো।   ফলে সেসব দেশে প্রতিবছরই নতুন নতুন প্রকল্পের ভিত্তিতে তৈরি হয় নতুন নতুন প্রযুক্তিপণ্য। আমাদেরকেও এ পথ অনুসরণ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। বর্তমান বিশ্বের প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এ মুহূর্তে তথ্যপ্রযুক্তিই দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত। তাই এ খাতকে এগিয়ে নিলে জাতি আরও উন্নত হবে। আমরা কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা এজন্য কাজ করছি। আমি দেশের শিল্পপতিদেরও এ সেক্টরে বিনিয়োগের আহ্বান জানাই। কারণ, প্রযুক্তি ব্যবসাই আগামীর নেতৃত্বদানকারী ব্যবসা।

ফিরে দেখা বিসিএস কম্পিউটার সিটি
রাজধানী আগারগাঁওস্থ আইডিবি ভবনের বিসিএস কম্পিউটার সিটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কম্পিউটার মার্কেট। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি এডুকেশন ওয়াকফ (আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউ) এর সহযোগিতায় এ সিটি গড়ে ওঠে।

১৯৯৮ সালে বিসিএস মেলা আয়োজনের জন্য সুপরিসর জায়গা এবং সুষ্ঠুভাবে মেলা করা যায় এরকম জায়গা খোঁজ হচ্ছিলো। পরে আইডিবি ভবনের এই মার্কেটকে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির মেলা আয়োজনের জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির আয়োজনে ১৯৯৮ সালের কম্পিউটার মেলা আইডিবি ভবনের এই মার্কেটে অনুষ্ঠিত হয় । সেই সঙ্গে অভাবনীয় সাড়া ফেলে সারা দেশে। সে মেলায় বর্তমানের মতো সুসজ্জিত দোকান ছিল না। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ভাড়ায় আসবাব কিনে বা সাময়িকভাবে তৈরি করে মেলায় অংশ নেয় । তারপরও এটি দেশব্যাপী পরিচিতি পায়।

১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার শেরেবাংলানগরের আইডিবি ভবনে কম্পিউটার বিক্রি করার একটি একক বাজারের জন্ম হয়। বাংলাদেশের কম্পিউটার জগতের খুব কম মানুষই আছেন, যারা এ কম্পিউটার বাজারটির কথা শোনেননি বা সুযোগ পেলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য বাজারটি ঘুরে আসেননি। যখন কেউ কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইও খুঁজে পান না, তখন এখানে আসেন।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অগ্রসর করতে ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরিতে বর্তমানের বিসিএস কম্পিউটার সিটির অবদান সিংহভাগ। ১৯৯৮ সালের মেলার পর থেকেই দোকান বরাদ্দ নেওয়া শুরু হয়। তখন অনেকটা ডেকে ডেকে, একে-তাকে খবর দিয়ে, প্ররোচিত করে দোকান বরাদ্দ নিতে উৎসাহিত করা হতো। এখন এ মার্কেটে ১৫৮ টি দোকান রয়েছে। এখন এখানে দোকান পাওয়া অনেকটা স্বপ্নের মতো।

২০০০ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির উদ্যোগে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।
এই কমিটি ২০০০ সালে ‘সিটিআইটি ফেয়ার’ নামে ‘বিসিএস কম্পিউটার সিটি’ মার্কেটে মেলা আয়োজন করে। মেলায় অংশগ্রহণকারী মূলত মার্কেটের দোকানগুলোই। এর বাইরে মিডিয়াসহ কিছু স্টল থাকত।

সেই আহ্বায়ক কমিটি থেকে পরবর্তীতে দু’বছর মেয়াদী নির্বাচিত কমিটি হয়ে আসছে। প্রতি বছর মেলার আয়োজনের চেহারাও আগের মতো নেই। নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা মেলা আয়োজন ছাড়াও মার্কেটের অভ্যন্তরীণ দেখভাল করে থাকেন। আজকের এই কম্পিউটার সিটি দেশের প্রায় ৬০%-৭০% হার্ডওয়্যার ব্যবসা ধরে রেখেছে। এর হার প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলা যায়, দেশের প্রযুক্তি পণ্যের প্রায় ৪০- ৫০ ভাগ সরবরাহ করা হয় এই মার্কেট থেকেই।

`৯৬ এবং `৯৭ সালেও কম্পউটার মেলা হতো আজকের রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেন ও টেনিস কোর্টজুড়ে। `৯৩ সালে যেখানে মাত্র ৩ হাজার বর্গফুট জায়গায় মেলা হয়েছিল সেখানে `৯৭ সালে ১৪ হাজার বর্গফুট জায়গায় মেলা হয়। ততদিনে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এতই বেড়েছিল, অনেকেই তার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা পায়নি। আয়োজকরা মেলার জন্য আরও বড় জায়গা খুঁজছিলেন। কিন্তু ঢাকায় দু’টি বড় হোটেলের বাইরে মেলা করার জায়গা ছিল না। দু’টি বড় হোটেলের একটিতে খোলা আকাশের নিচে ১৪ হাজার, আর অন্যটিতে মাত্র ৮ হাজার বর্গফুট মেলার জায়গা পাওয়া যায়।

তখনই শোনা গেল, ঢাকার শেরেবাংলা নগরের আইডিবি ভবনে পাঁচ তলা একটি শপিংমল তৈরি হয়েছে। যেটিতে অলঙ্কারের বাজার করার কথা ভাবা হচ্ছে। মার্কেটটি ঘুরে দেখা গেল, পরের বছর মেলা করা যেতে পারে। এতো দূরে নির্জন এলাকায় মানুষ কম্পিউটার দেখতে যাবে  কি না তা নিয়ে আয়োজকদের শঙ্কা ছিল।

১৯৯৮ সালে আইডিবি ভবনের সেই বাজারে বিসিএস কম্পিউটার শো ১৯৯৮ আয়োজন করে বিসিএস কমিটি। পাঁচটি ফ্লোরজুড়ে প্রায় এক লাখ বর্গফুট জায়গায় বিশাল সেই আয়োজন বাংলাদেশের আইসিটির ইতিহাসে এক বিশাল মাইলফলক।

সেই থেকে আইডিবির শপিংমল এলাকায় বিসিএস কম্পিউটার সিটি চলে আসছে। অবিরাম চলার মাঝে এই কম্পিউটার বাজারটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

কম্পিউটারের এ বাজারটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রে একটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি কেবল একটি কেনাকাটার জায়গা হিসেবে আর দশটি শপিংমলের মতো বাণিজ্য কেন্দ্র হয়নি। প্রথমত, তথ্যপ্রযুক্তির একটি স্থায়ী শোকেস হিসেবে কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, এটি তথ্যপ্রযুক্তিপ্রেমী মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ বিকাশের একটি প্রতীক হচ্ছে, এই শপিংমল।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর/ আহমেদ রাজু, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।