ঢাকা: বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে শুরু হওয়া ‘জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন (১২টি জেলায়)’ প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সাত বছর পরেও প্রকল্পটির তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে, প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ৩৬ শতাংশ হয়েছে এবং চারটি জেলায় প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং ব্যয়ও ১২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৪,১৯৭.৮০ কোটি টাকার প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, ৯ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) রেহানা পারভীনের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) একটি মিটিং আয়োজন করেছে। সেখানে প্রকল্পের ব্যয় কমানোর জন্য বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ঠিক করে দিলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে, প্রকল্পের অগ্রগতি অত্যন্ত কম হওয়ায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা ও সিলেট—এই চার জেলার কাজ বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব জেলায় প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ হওয়ায় সরকার মনে করছে, এই চারটি জেলা বাদ দিলে প্রকল্পের ব্যয় কমবে এবং সরকারের ওপর চাপ কিছুটা হ্রাস পাবে।
প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এ কে এ এম ফজলুল হক বলেন, এই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য পুনরায় পিইসি মিটিংয়ে আলোচনা করতে হবে। কারণ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় অংশীদারও রয়েছে। এই বিষয়ে ইআরডি’র মাধ্যমে ত্রিপক্ষীয় মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর ইআরডি, প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থা এবং ভারতীয় অংশীদারদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনা ছিল, তা এখন আর প্রযোজ্য নয়।
ফজলুল হক বলেন, যদি চারটি সাইট বাদ পড়ে তাহলে প্রকল্পের ব্যয় কমবে এবং জিওবি পার্টের ব্যয়ও হ্রাস পাবে। এর ফলে সরকারের আর্থিক চাপ কিছুটা কমে আসবে।
জিওবি পার্টের ব্যয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর কথা ছিল, তবে তা এখন অর্ধেকে নেমে আসবে। এর মধ্যে ১৭৮৩ কোটি টাকা সিডি ভ্যাট (ভারত থেকে মালামাল আনার জন্য সরকারকে পরিশোধ করতে হয়) অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিডি ভ্যাটটি কমিয়ে আনলে সরকারের প্রায় ১,৩০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
৪ মাস বন্ধ কাজ
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকল্পের কাজ ফেলে চলে যান ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে প্রায় চার মাস বন্ধ প্রকল্পের কাজ। চলতি বছরের জুন নাগাদ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও অগ্রগতি মাত্র ৩৬ শতাংশ। ফলে কবে নাগাদ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। নিরাপত্তার কারণে ভারতীয় ঠিকাদারেরা প্রকল্প এলাকা থেকে চলে গেছেন। তবে আশার খবর হলো, ভারতীয়রা অর্ধেকের বেশি ফিরে এসেছেন।
প্রকল্পের পরিচালক বলেন, প্রকল্পের কর্মীদের বেতন বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রকল্পের জন্য কর্মরত ৫২ জনের মধ্যে বেশির ভাগই চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। বর্তমানে আমাদের অনেকের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে, কারণ হাই-টেক পার্কের কাজ বন্ধ থাকার বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে, সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পের ব্যয় এবং খরচের চাপ কমাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের রিভাইস ও সংশোধন
ভারত থেকে নির্মাণসামগ্রী আনতে না পারায় কাজ বন্ধ রয়েছে এবং প্রকল্পটির অগ্রগতি থেমে গেছে। মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১,৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যার মধ্যে ২৫২ কোটি ৪০ লাখ টাকা সরকারি অর্থায়ন এবং ১,৫৪৪ কোটি টাকা ঋণ। প্রথমে ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হলেও এনইসি সভার পর ২০২১ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।
প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বাড়িয়ে ১,৮৪৬ কোটি টাকা এবং মেয়াদ ২০২৪ এর জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় ৪,১৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যার মধ্যে ২,২৫১.৭১ টাকা বৃদ্ধি করা হবে (১২৭.৩৯% বৃদ্ধি) এবং মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
যে কারণে কাজে অগ্রগতি কম
বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, বিভিন্ন স্থানে জমি বরাদ্দ ও অধিগ্রহণে বিলম্ব, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, কিছু কিছু ক্রয় প্যাকেজের ক্ষেত্রে দরদাতাদের অংশগ্রহণের অভাবে পুনঃদরপত্র আহ্বান, ভারতীয় পরামর্শক সংস্থা ১২টি জেলার বিভিন্ন প্যাকেজের ডিজাইন এবং প্রাক্কলনসহ সরবরাহে বিলম্ব ঘটা ইত্যাদি কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে।
ভারতীয় সরঞ্জাম আমদানির জন্য চুক্তি সংশোধন
ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত এলওসি চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের ৭৫% সরঞ্জাম ভারত থেকে আমদানি করার কথা থাকলেও, তা কমিয়ে ৬৫% করা হয়েছে। বাকি ৩৫% সরঞ্জাম বাংলাদেশে সরবরাহ করবে। তবে, সিডি ভ্যাটসহ শুল্ক খাতে পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ভারত থেকে সরঞ্জাম আমদানি সম্ভব হচ্ছে না।
প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, ডিপিপিতে সিডি ভ্যাটের জন্য মাত্র ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ কারণে বর্তমানে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা ভারত থেকে মেশিনারিজ আনতে পারছি না, কারণ সিডি ভ্যাটের জন্য পর্যাপ্ত টাকা বরাদ্দ নেই। সিডি ভ্যাটের টাকার সমাধান না হলে কাজ শুরু করা যাবে তবে কাজের অগ্রগতি হবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২৪
এসএমএকে/এমজেএফ