ঢাকা: উচ্চ কর হার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও মোবাইল অপারেটরগুলোর উদাসীনতায় চালুর ছয় বছরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে এক নম্বরে সব মোবাইল অপারেটরের সেবাদান তথা-এমএনপি (মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি)।
লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বলছে, শুরুর বছরে গ্রাহকের ভালো সাড়া পাওয়া গেলেও বছর বছর উচ্চ কর হার, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং মোবাইল অপারেটরগুলোর উদাসীনতায় দিনে দিনে এমএনপি সেবা নেওয়া গ্রাহকের সংখ্যা কমতির দিকে।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) রাজধানীর রাওয়া কমপ্লেক্সে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ-টিআরএনবি আয়োজিত এক সেমিনারে এমন তথ্য জানানো হয়। টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন এসময় বক্তব্য দেন।
এমএনপি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ইনফোজিলিয়ন টেলিটক বিডির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. মোস্তফা কামাল জানান, প্রাথমিক দিকে এমএনপির সাড়া বেশ ভালো ছিল। ট্যাক্স আরোপ করায় কমে যায়। বর্তমানে যে সিম ট্যাক্স অনেক বেশি, যেটা আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস না। এত টাকা সিম ট্যাক্স গ্রাহকের ওপর জুলুম হয়ে যায়। আর আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুযায়ী, মোবাইল অপারেটররা এমএনপি সেবা গ্রাহক পর্যায়ে নিয়ে যায়। এটা চালু হলেও এখন আমাদের দেশে নেই। রেগুলেটর ও মোবাইল অপারেটরদের পক্ষ থেকে প্রচারণা এবং প্রণোদনা থাকতে হবে।
বিটিআরসির বর্তমান কমিশন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ উল্লেখ করে সিইও বলেন, গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনা করে কমিশন এমএনপিকে সুদৃষ্টিতে দেখবে এবং মোবাইল অপারেটরদের বাধা তুলে দেওয়ার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে বলে আমরা আশা করি।
ইনফোজিলিয়ন টেলিটক বিডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাবরুর হোসেন বলেন, আগে যে চ্যালেঞ্জগুলো ফেস করতাম, বর্তমান কমিশন সেগুলো বিবেচনা করে গ্রাহকস্বার্থে এমএনপি সেবা সহজ করে দেবে আশা করি। বর্তমানের বাধাগুলো দূর করলে বিদেশি বিনিয়োগও ফ্রুটফুল হবে।
এমএনপি হলো এমন এক প্রযুক্তিসেবা, যার মাধ্যমে মোবাইলফোন গ্রাহকদের প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকে। কেননা গ্রাহকরা তাদের মোবাইলফোন নম্বর অপরিবর্তিত রেখে স্বাধীনভাবে তাদের সুবিধা অনুযায়ী অপারেটর পরিবর্তন করতে পারেন। এর মাধ্যমে উন্নত গ্রাহক সেবার পাশাপাশি মোবাইল অপারেটররা তাদের নেটওয়ার্কে কোয়ালিটি অফ সার্ভিস নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকে।
২০১৭ সালে টেন্ডার প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করে ইনফোজিলিয়ন টেলিটক বিডি লিমিটেড ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে এমএনপি (একসঙ্গে পোর্টিং এবং ডিপিং সেবা পরিচালনা করার জন্য) লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়। এমএনপি লাইসেন্সিং গাইডলাইনে এই সেবাকে একটি রেগুলেটরি টুল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমএনপি ব্যবহার করে সেবার মান উন্নয়নসহ অপারেটরদের রেগুলেট করা সম্ভব। কিন্তু এটি অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় যে এমএনপি সেবা ২০১৮ সালে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত এটি সফলতা পায়নি বলে সেমিনারে উল্লেখ করা হয়।
ইনফোজিলিয়নের তথ্যানুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার গ্রাহক পোর্টিং করেন। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৩ লাখ ৯৬ জন অপারেটর পরিবর্তন করে সেবা নিয়েছেন। শুরুর বছরে ৬ লাখ ৯০ হাজার গ্রাহক থাকলেও পরের বছরগুলোতে কমতে থাকে।
দেশে এমএনপি সেবা সফলতা না পাওয়ার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়।
বিটিআরসি এবং মোবাইলসেবা প্রদানকারী অপারেটরদের চরম উদাসীনতা:
বিটিআরসি এবং মোবাইলসেবা প্রদানকারী অপারেটরদের চরম উদাসীনতা সফলতা পায়নি অভিযোগ করে বলা হয়, বিটিআরসির লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুযায়ী এমএনপি সেবাকে জনপ্রিয় করার বিষয়ে এবং মোবাইল অপারেটদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে এমএনপি সেবাকে জনপ্রিয় করার জন্য যেখানে মোবাইল অপারেটরেরা বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে থাকে, সেখানে বাংলাদেশে বিটিআরসির নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে মোবাইল অপারেটররা কোনো ধরনের প্রণোদনা দিতে পারে না। এই বিষয়ে বিভিন্ন সময় ইনফোজিলিয়ন বিটিআরসিকে জানালে বিটিআরসি এই বিষয়ে একমত পোষণ করে একটি নির্দেশিকা জারি করে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বিটিআরসি এই নির্দেশনাটি জারির সামান্য সময়ের মধ্যে বাতিল করা হয়, যা অত্যন্ত হতাশাজনক।
এমএনপি সেবায় উচ্চকর আরোপ:
প্রথমদিকে সিম করের উচ্চহার এমএনপি সেবাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছিল, যা মোবাইল ব্যবহারকারীদের নম্বর পরিবর্তনে নিরুৎসাহিত করেছিল। ফলে সে সময় নম্বর পোর্ট করার অনুরোধের সংখ্যা প্রত্যাশার তুলনায় কম ছিল। এই অবস্থার উন্নতির জন্য এবং সেবা সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও আকর্ষণীয় করার উদ্দেশে এনবিআর বিবেচনা করে সিম কর মওকুফ করেছিল। ফলে গ্রাহকরা কম খরচে এমএনপি ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন এবং পোর্টিং সংখ্যা বাড়ে।
তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সিম কর মওকুফ বাতিল করা হয়। ফলে পুনরায় সিম কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এবং পোর্টিং সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে এমএনপি সেবাগ্রহণ করতে হলে গ্রাহক পর্যায়ে এমএনপি ফি বাবদ ৪৫০ টাকা দিতে হয়, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিটিআরসি এবং এনবিআর কাছে এ বিষয়টি দেশ এবং গ্রাহকস্বার্থে পুনর্বিবেচনার জন্য বলা হলেও অদ্যাবধি এর সমাধান হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোর্টিং এবং ডিপিং এমএনপি সেবায় অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিদ্যমান পোর্টিং এর বাধাগুলো পর্যালোচনা না করে ডিপিং সার্ভিসের বিষয়ে কোনো পরিবর্তন এমএনপি সেবার জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।
এমএনপি সেবাকে দেশ এবং গ্রাহক স্বার্থে সফল করতে কয়েক দফা কার্যক্রম নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিটিআরসির ২০১৮ সালের এমএনপি বিষয়ক নির্দেশিকা বাতিল করে মোবাইল অপারেটরদের এমএনপি সেবায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে বাধা দূর করা। বিটিআরসি থেকে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করে দেশ এবং গ্রাহকস্বার্থে এ সেবায় উচ্চ করের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান করা যেতে পারে।
তারা আরও বলছেন, এমএনপি গ্রাহকরা মাস্কিং এসএমএস প্রাপ্তির বিষয়টি বিটিআরসি পুনর্বিবেচনা করতে পারে। এমএনপি সেবাগুলিকে (পোর্টিং এবং ডিপিং) সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এটুপি এসএমএস সেবায় বিদ্যমান ডাইরেক্ট ক্লায়েন্ট বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
এমআইএইচ/এসআরএস