রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, তার উত্থান শুরু হয় প্রায় তিন দশক আগে ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপরে তিনবার প্রধানমন্ত্রী ও দুই দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
তুরস্ক যখন বিধ্বংসী ভয়াবহ ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় মোকাবিলার চেষ্টা করছে, তখনই প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে এই কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের এই ভূমিকম্পে তুরস্কে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গৃহহীন হয়েছে ১৫ লাখের মতো মানুষ। এ দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও রয়েছে তুরস্কের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও টালমাটাল। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৬ সালে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান চেষ্টা থেকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বেঁচে গেলেও, আসন্ন নির্বাচনে তিনি কতোটা সফল হবেন সেটা নির্ভর করছে তার সরকার কীভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে তার ওপর।
টালমাটাল অর্থনীতি ও ভূমিকম্প
নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা হলো সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। জনমত সমীক্ষায় তিনি ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছেন।
চরম মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার খরচের লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে কারণে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন করুণ। ডলারের বিপরীতে তুর্কী লিরার দাম কমেছে রেকর্ড পর্যায়ে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে সর্বশেষ ভূমিকম্প।
আঙ্কারার সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সরওয়ার আলম বলছেন, এসব ইস্যুই মে মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন এরদোয়ানের জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলছেন, “ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের অর্থনীতিতে যে সমস্যা শুরু হয় সেটা তিনি কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। বর্তমানে তুরস্কের মুদ্রা লিরার মূল্য ডলারের বিপরীতে রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ”
“ভূমিকম্পের পরপরই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী কেন দুর্গত মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারেনি তা নিয়েও মানুষের ভেতরে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে,” বলেন মি. আলম। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এজন্য অবশ্য রাস্তাঘাট ভেঙে পড়াকে দায়ী করেছেন।
বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরদোয়ানের জন্য কঠিন এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কতোটা সহজ হবে সেটা নির্ভর করছে বিরোধী দলগুলোর একজোট থাকতে পারার ওপর। ছয়টি দল নিয়ে গঠিত এবং ‘টেবল অব সিক্স’ নামে পরিচিত এই জোট নিজেদের মতবিরোধ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচনে একক প্রার্থী দিতে সম্মত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে যিনি বিরোধী জোটের প্রার্থী হয়েছেন তিনি জোটের সবচেয়ে বড় ও ধর্মনিরপেক্ষ দল পিপলস পার্টি বা সিএইচপির প্রধান- ৭৪ বছর বয়সী কেমাল কিলিচদারুগলু।
বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা বলছে, এরদোয়ানের সঙ্গে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এই সিএইচপি দলটি গঠন করেছিলেন। এটি সবচেয়ে পুরনো দল, তবে নব্বই-এর দশক থেকে এটি ক্ষমতার বাইরে।
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কে প্রার্থী হবেন সেটা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে টানাপড়েন চলছিল এক বছর ধরে। বিরোধী জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল গুড পার্টি ইস্তাম্বুল কিম্বা আঙ্কারার মেয়রকে প্রার্থী করতে চেয়েছিল।
ইস্তাম্বুলের মেয়র একরাম ইমামগুলুর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল একে পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নিজেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী জোটের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে মি. কিলিচদারুগলু জয়ী হলে এই দুজন মেয়রকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
আঙ্কারার সাংবাদিক সরওয়ার আলম বলছেন, কামাল কিলিচদারুগলু ২০১২ সাল থেকে বিরোধী সিএইচপি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তিনি এই দল সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
“মানুষের একটা ধারণা ছিল যে সিএইচপি হচ্ছে কট্টর বামপন্থী, কিম্বা শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দল, অথবা শুধুমাত্র আতাতুর্কের দল। তিনি এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে সব ধরনের মতাদর্শের লোক রয়েছে। এমনকি ইসলামপন্থীরাও তার সঙ্গে রয়েছে। এসব কারণে তুরস্কের রাজনীতিতে তিনি নতুন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন,” বলেন তিনি।
এরদোয়ানের রাজনৈতিক পরীক্ষা
মি. কিলিচদারুগলুর নেতৃত্বে বিরোধীরা যে প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে মূল কথা হচ্ছে- তুরস্কে এক ব্যক্তির শাসনের অবসান ঘটানো, আইনের শাসন ও সবার জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। মি. কিলিচদারুগলু প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে এরদোয়ানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোট তাদের প্রচারণায় বলছে – বিরোধী জোটের মতো বহু দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হবে। তারা বলছে বিরোধীরা তাদের প্রার্থী দিতেই এক বছর সময় নিয়েছে। কখনো জোট ভেঙে গেছে, পরে আবার জোড়া লেগেছে। এরকম মতবিরোধ নিয়ে তারা কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে? ফলে এধরনের কোয়ালিশন সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না।
তুরস্কে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দুই পর্যায়ে। প্রথম ধাপে যদি কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তখন সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দু’জন প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলছেন, “প্রথম পর্যায়ের ভোটে এরদোয়ানের ভোট যদি ৫০ শতাংশের নিচে রেখে দেওয়া যায়, তাহলে তিনি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যেতে পারেন। ”
আঙ্কারার সাংবাদিক সরওয়ার আলম বলছেন, “বিরোধী জোটের প্রার্থী কেমাল কিলিচদারুগলুর চেয়েও এরদোয়ানের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেশি। কিন্তু বিরোধীরা যদি তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। ”
তবে তিনি বলছেন, এরদোয়ানের জন্য এবারের নির্বাচন আগের নির্বাচনগুলোর মতো সহজ হবে না।
তুরস্কে এমন এক সময়ে এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন দেশটির স্বাধীনতা অর্জনের শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। আর এই নির্বাচনেই ৬৯-বছর বয়সী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারিত হবে।
সূত্র- বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২৩
এমএইচএস