ঢাকা, রবিবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ জুন ২০২৪, ১৫ জিলহজ ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

যৌতুকের জন্য হত্যার সন্দেহ যেভাবে ‘শেষ’ করলো দুই পরিবারকে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২২ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৪
যৌতুকের জন্য হত্যার সন্দেহ যেভাবে ‘শেষ’ করলো দুই পরিবারকে ২০২৩ সালে ধুমধাম করে বিয়ে হয় অংশু ও আনশিকার। ছবি: সংগৃহীত

সময়টা গত ১৮ মার্চ মধ্যরাত। ঘটনাস্থল ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ শহর।

দুই মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে তুমুল মারামারি।

‘রাত ১১টার দিকে ৬০-৭০ জন লোক আমাদের বাড়িতে ঢুকে। এরপর আমাদের ঘরের সবাইকে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে’, বলছিলেন শিবানি কেসরওয়ানি নামে এক তরুণী।

তার ভাষ্যে, ওই হামলাকারীদের মধ্যে তার ভাই অংশুর স্ত্রী আনশিকার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রাও ছিল।

এই ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগেই শিবানিদের ঘরে আনশিকার ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়।

শিবানি ও পুলিশের ভাষায়, আনশিকা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তার স্বজন ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ, যৌতুকের জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।

শিবানিদের যৌথ পরিবার ছিল। এই পরিবারের ছিল কাঠের ব্যবসা। বেজমেন্ট ও নিচের ফ্লোরে ছিল কাঠের গুদাম ও দোকান। এর ওপরে থাকতো ওই পরিবার। ওপরের প্রত্যেক ফ্লোরে একটি করে বেডরুম ছিল। ঘটনার বছরখানেক আগে বিয়ে করা অংশু তার স্ত্রী আনশিকাকে নিয়ে থাকতেন ওপরের ফ্লোরে। তার মা-বাবা থাকতেন প্রথম ফ্লোরে। আর দ্বিতীয় ফ্লোরে থাকতেন বোন শিবানি।

‘আনশিকা সাধারণত রাত ৮টায় খাবার খেতে নিচে নেমে আসতো। কিন্তু সেদিন সে নামেনি। আমরা ভাবলাম, সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে’, বলছিলেন শিবানি।

তিনি জানান, তার ভাই (অংশু) রাত ১০টায় দোকান থেকে ঘরে ফেরেন এবং তার স্ত্রীকে ডাকতে ওপরে যান। বারবার ডাকাডাকি ও কড়া নেড়েও যখন সাড়া মিলছিল না, অংশু দরজা ভেঙে ফেলেন। ঘরে ঢুকে তিনি আনশিকার ঝুলন্ত মরদেহ দেখতে পান। তখন তিনি চিৎকার করতে থাকলে ঘরের সবাই ওপরে ছুটে যান।

ঘরের সিঁড়িতে পুড়ে মৃত্যু হয় মায়ের, বলতে বলতে কাঁদছিলেন শিবানি।  ছবি: সংগৃহীতএরপর অংশু ও তার চাচা আধা কিলোমিটার দূরত্বের থানা পুলিশে খবর দেন। খবরটি জানানো হয় আনশিকার মা-বাবাকেও।

পুলিশের ভাষ্যমতে, এর আধঘণ্টার মধ্যে আনশিকার পরিবার অর্ধশতাধিক লোক নিয়ে আসে অংশুদের বাড়িতে। মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে তারা আক্রমণ করে অংশুর ঘরের লোকজনকে। মুহূর্তের মধ্যে দুই পরিবারের লোকজনের মধ্যে মারামারি বেঁধে যায়।

ঘটনার কিছু মুহূর্ত শিবানির মোবাইল ফোনে ভিডিও আকারে রেকর্ড আছে। এতে দেখা যায়, লোকজন কাঠের লাঠি হাতে মারামারি করছে। একজন পুলিশ সদস্য মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের থামাতে চাইলেও ব্যর্থ হন।

পুলিশ আনশিকার মরদেহ ঘর থেকে বের করতেই তার স্বজনরা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

বেজমেন্ট ও নিচতলায় কাঠের গুদাম ও দোকান থাকায় বাড়ির আগুন ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরে আটকা পড়েন শিবানি, তার মা-বাবা ও এক আন্টি।

শিবানি ও তার আন্টি দ্বিতীয় তলার জানালা ভেঙে বহু কায়দা করে তাদের ঘর লাগোয়া চাচাদের ঘর দিয়ে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তার মা-বাবা বের হতে পারেননি।

খবর পেয়ে যতক্ষণে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসে, ততক্ষণে পুরো ঘর নরক হয়ে যায়। রাত ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ভস্মীভূত ঘরে গিয়ে অংশু-শিবানির মা-বাবার পোড়া মরদেহ উদ্ধার করে।

কাঁদতে কাঁদতে শিবানি বলছিলেন, ‘আমার মায়ের মরদেহ সিঁড়িতে পাওয়া যায়। থলেতে ভরে তার মরদেহ মর্গে নিতে হয়েছিল। ’ 

সেই ভয়াবহ ঘটনার পর শিবানি বাদী হয়ে আনশিকার পরিবারের ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৬০-৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটির পর আনশিকার বাবা-চাচা, তাদের ছেলেসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়।  

আবার আনশিকার পরিবারও অংশু, তার মা-বাবা ও বোনকে আসামি করে পাল্টা মামলা করেছে। এতে তাদের মেয়েকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে।

নিজের মোবাইল ফোনে মা-বাবার ছবি দেখাচ্ছেন শিবানি, যা এখন কেবলই স্মৃতি।  ছবি: সংগৃহীতশিবানি তার পরিবারের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নাকচ করে দেন। যদিও তিনি স্বীকার করেন, বিয়েতে আনশিকার পরিবার থেকে তারা গাড়িসহ অনেক উপহার পেয়েছিলেন।

‘তারা যা দিয়েছেন নিজেদের ইচ্ছেতেই, আমরা কিছুই চাইনি’, দাবি করেন শিবানি।

তিনি বলেন, স্ত্রী মারা যাওয়ার রাতের ঘটনার পর অংশু আর বাড়ি ফেরেনি। সে তার প্রাণনাশের ঝুঁকিতে আছে, কারণ মামলার আসামি আনশিকার বেশিরভাগ আত্মীয়ই এখনো গ্রেপ্তার হননি।

১৯৬১ সাল থেকেই ভারতে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া বেআইনি। কিন্তু জরিপ মতে, দেশটির ৯০ শতাংশ বিয়েতেই এখনো যৌতুক লেনদেন হয়।

পুলিশ প্রতিবছর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের হাজার হাজার অভিযোগ পায়। পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভারতে ৩৫ হাজার ৪৯৩ নারী যৌতুককেন্দ্রিক খুন হয়েছেন।

কিন্তু যৌতুকের জন্য নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ এনে এমন নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা সচরাচর শোনা যায় না।

শিবানি এখন তার চাচার পরিবারের একটি ঘরেই থাকেন। সেখান থেকে প্রতিবেদককে নিজেদের ঘর ঘুরে দেখান। ঘরের প্রত্যেকটা জায়গায় যেন সে রাতের দগদগে ঘা। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পোড়া আসবাবপত্র। কালিতে মলিন ঘরের দেয়াল। মেঝে ঢেকে আছে মোটা ছাইয়ে।  

শিবানি বলছিলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার চাই। আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ঘর-পরিবার কিচ্ছু নেই। আমি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। যারা এতে জড়িত বলে দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের শাস্তি চাই। ’

তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা কেন ঘর পুড়িয়ে দিল? এখন আমরা কীভাবে কোনো প্রমাণ পাব?’

তিনি পুলিশের ওপরও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শিবানি বলেন, ‘ওই সময় অন্তত দু ডজন পুলিশ সদস্য আমাদের ঘরের সামনে ছিলেন। কিন্তু কেউ আমার মা-বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। ’

অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর এবং তখন সবাই আবেগতাড়িত ছিল। আমাদের নজর ছিল ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ বের করে নিয়ে আসা এবং ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নেওয়ার দিকে। আমরা সেখানে লোকসমাগম কমাতে এবং উত্তেজনা প্রশমিত করতে চেয়েছি। ’

ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে ক্রুদ্ধ লোকজন ঘরেই আগুন ধরিয়ে দেবে। এটা আকস্মিক ঘটেছে। আমরা তখনই ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেই। ওই ঘর থেকে পাঁচজনকে উদ্ধারে আমরাও সহায়তা করেছি। ’

এই ‘ডাবল ট্র্যাজেডি’ আনশিকার পরিবারকেও ‘শেষ’ করে দিয়েছে। প্রতিবেদক তার বাড়িতে গিয়ে দেখে, সদর দরজায় লোহার বড় তালা লাগানো।

আনশিকাদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরেই তার চাচার বাড়ি। ওই চাচা এবং তার ছেলেরাও শিবানির দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই পরিবারের কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।

আনশিকার নব্বই পেরোনো দাদা জওহর লাল কেসরওয়ানির ঘরের দরজায় কড়া নাড়লে তিনি বেরিয়ে আসেন। তার একজন নাতি প্লাস্টিকের চেয়ার বের করে দিলে তিনি সেখানে বসেন এবং দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

পোড়া ঘর বয়ে বেড়াচ্ছে তিনটে প্রাণহানির ঘা।  ছবি: সংগৃহীতপ্রতিবেদককে জওহর লাল বলেন, ‘আমি আর কী বলবো? আমার গোটা পরিবার কারাগারে। আমার ছেলে-নাতিরা...। তারা আনশিকাকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিল, যেন মনে হয় সে আত্মহত্যা করেছে। ’

জওহর লালের দাবি, তার নাতিনের বিয়ে বেশ ধুমধাম করে হয়েছিল। ‘আমরা ৫০ লাখ রুপি খরচ করেছি। তাদের ঘরের প্রয়োজনীয় সব দিয়েছি। এমনকি ১৫ লাখেরও বেশি রুপি দিয়ে একটা গাড়ি উপহার দিয়েছি। ’

‘গত ফেব্রুয়ারিতে আনশিকা আমাদের বাড়ি এসেছিল। তখন সে বলেছিল যে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা তখন তাকে বলেছিলাম, চুপ থাকতে এবং নিজেকে মানিয়ে নিতে। বলেছিলাম, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’, বলতে গিয়ে নাতনিকে হারানোর আক্ষেপ ঝরে এই বৃদ্ধের কণ্ঠে।

বিনয়ী, বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতার মানসিকতাসম্পন্ন বলেই এলাকায় পরিচিতি জওহর লালদের পরিবারের। সেই পরিবারের এমন ট্র্যাজেডিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা তাদের প্রতিবেশীদেরও স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

এক পড়শী বলছিলেন, ‘ওই পরিবারের লোকজন খুবই ভালো। আমরা তো চিন্তাও করতে পারছি না, কীভাবে ঘটনাটা এতদূর গড়ালো। কারণ, ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ার লোক তারা নন’।

‘আমরা জানি না আগুনটা কে ধরিয়েছে। কিন্তু নিজেদের মেয়ের লাশ দেখলে তো যে কেউই মেজাজ হারিয়ে ফেলবেন’, যোগ করেন তিনি।

প্রতিবেশী এক নারী বলেন, ‘আনশিকা খুবই মার্জিত আচরণের মেয়ে ছিল। ভীষণ মিষ্টি। তাদের পরিবারের লোকজনও অমায়িক ছিল। যে নৃশংস প্রতিশোধের জন্য তাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তারা এমন হতে পারেন না। ’

‘আনশিকার শ্বশুর-শাশুড়ির আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক’, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে যে, এখন কেউই বলছে না আনশিকার কী হয়েছিল। কীভাবে মারা গেল মেয়েটা?’

(সূত্র: বিবিসি)

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৪
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।