ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সিরিয়ায় কারা যুদ্ধ করছে, কোন পক্ষ কী চায়?

রকিবুল সুলভ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২৪
সিরিয়ায় কারা যুদ্ধ করছে, কোন পক্ষ কী চায়? বাঁয়ে বাশার আল-আসাদ, ডানে এইটিএস যোদ্ধা

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। অথচ যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল দেশটির প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে।

 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। বহু শহর ধ্বংস হয়ে গেছে অন্যান্য দেশও জড়িয়ে পড়েছে। বহু মানুষ বাস্তুচ্যুতও হয়েছে।

সংঘাত শুরুর আগে থেকেই অনেক সিরিয়ান বেকারত্বের উচ্চ হার, দুর্নীতি এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার মতো বিষয় অভিযোগ তুলে আসছিল। এসব নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে অস্থিরতা ছিল। বাশার ২০০০ সালে তার বাবা হাফেজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন।

২০১১ সালের মার্চ মাসে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বৈরাচার বিদ্রোহ থেকে প্রভাবিত হয়ে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দারা শহরে গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। সিরিয়ার সরকার বিক্ষোভ ঠেকাতে দমন-পীড়ন শুরু করলে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি ওঠে।  

প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে দমন অভিযান আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিরোধী সমর্থকেরা প্রথমে নিজেদের রক্ষা করতে এবং পরে নিরাপত্তা বাহিনীকে তাদের এলাকা থেকে তাড়াতে অস্ত্র তুলে নেয়। প্রেসিডেন্ট আসাদ বিক্ষোভকে ‘বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাস’ দমনের প্রতিশ্রুতি দেন।

সংঘাত দ্রুত ছড়াতে থাকে এবং দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। শত শত বিদ্রোহী দল গড়ে ওঠে, আর খুব দ্রুত এই সংঘাত আসাদের পক্ষে বা বিপক্ষে যুদ্ধে সীমাবদ্ধ না থেকে আরও জটিল হয়ে পড়ে।

বিদেশি শক্তিগুলো বিভিন্ন পক্ষ নেয় এবং অর্থ, অস্ত্র ও যোদ্ধা পাঠাতে শুরু করে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার মতো বিদ্রোহী দলগুলো নিজ নিজ লক্ষ্য নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।  
 
সিরিয়ার কুর্দি যারা নিজস্ব শাসনের অধিকার চায়, কিন্তু আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি, তারা সংঘাতে আরেকটি মাত্রা যোগ করে।

জিহাদিসহ যে কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আসাদ সরকারের বিরোধিতা করেছিল তারা প্রথমে দেশটির বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। পরে সিরিয়া সরকার রাশিয়া ও অন্য সহযোগীদের সহায়তায় দেশটির অধিকাংশ এলাকা পুনর্দখলে নেয়।  

গৃহযুদ্ধে কোন পক্ষ কী চায়? 

যুদ্ধে আসাদ সরকারের প্রধান সমর্থক রাশিয়া ও ইরান। তুরস্ক, পশ্চিমা শক্তি এবং কয়েকটি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র সংঘাতে দলগুলোকে বিভিন্ন মাত্রায় সমর্থন দিয়েছে।

সিরিয়ায় যুদ্ধের আগেও রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি ছিল। ২০১৫ সালে রুশ বাহিনী আসাদের পক্ষে একটি বিমান অভিযান শুরু করে, যা সরকারের পক্ষে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাশিয়ার সামরিক বাহিনী দাবি করে আসছে তাদের লক্ষ্য যোদ্ধারা। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীরা নিয়মিতভাবেই বলছেন, প্রতিনিয়ত তারা মূলধারার বিদ্রোহী ও বেসামরিকদের হত্যা করে।

ধারণা করা হয়, ইরান প্রেসিডেন্ট আসাদকে সাহায্য করতে সেনা পাঠানোর পাশাপাশি বহু বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।

সশস্ত্র, প্রশিক্ষিত এবং ইরানের অর্থায়িত হাজার হাজার শিয়া মুসলিম যোদ্ধা সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তাদের বেশিরভাগই লেবাননের হিজবুল্লাহ থেকে আসা। তবে ইরাক, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনেরও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তাদের ভাষায় ‘মধ্যপন্থী’ বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সাহায্য করে। তবে কিন্তু বিদ্রোহী যোদ্ধারা প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হওয়ার পর থেকে তারা প্রাণঘাতী নয় এমন সহায়তার দিকে যায়।  

২০১৪ সাল থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি বৈশ্বিক জোট সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করে এবং বিশেষ বাহিনী পাঠায়, যেন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নামে কুর্দি ও আরব যোদ্ধাদের জোটটি উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আইএস যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এলাকা পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং গোষ্ঠীটির পুনর্গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে পারে।

যুদ্ধে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বিভিন্ন মতাদর্শের অধীনে থাকা বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীকে একত্রিত করে, যারা তুরস্ক থেকে অর্থ এবং অস্ত্র সহায়তা পায়। এই জোটে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টও রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আহরার আল-শামের মতো গোষ্ঠী, যাদের লক্ষ্য হলো আসাদ সরকারের পতন ঘটানো এবং শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

তুরস্ক মূলত কুর্দি ওয়াইপিজি (পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটস) যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে। সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস নামের ওই জোটে কুর্দি এই গোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে। তুরস্ক মনে করে ওয়াইপিজি তাদের নিষিদ্ধ কুর্দি গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) একটি অংশ।

সিরিয়ার দক্ষিণে দ্রুজ ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের সাম্প্রতিক লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার খবর পাওয়া যায়।

ইরানের প্রভাব মোকাবিলায় সৌদি আরব যুদ্ধের শুরুতেই বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দেয়। আসাদের সঙ্গে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পর্ক না থাকলেও তারা সিরিয়াকে আরব দেশগুলোর মধ্যে ফিরিয়ে আনার উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি এবং হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য শিয়া গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে ইসরায়েল এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে তারা এই অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে বিমান হামলা বাড়িয়ে দেয়।

সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের সাম্প্রতিক আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই গোষ্ঠীর সিরিয়ার সংঘর্ষে একটি দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে।

২০১১ সালে আল-কায়দার সরাসরি সহযোগী হিসেবে জাবহাত আল-নুসরা নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এইচটিএস গোষ্ঠী। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি।

গোষ্ঠীটিকে প্রেসিডেন্ট আসাদ-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর এবং প্রাণঘাতী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বিপ্লবী উৎসাহের বিপরীতে জিহাদি মতাদর্শই ছিল গোষ্ঠীটির মূল চালিকাশক্তি। ফ্রি সিরিয়া নামে বিদ্রোহীদের যে জোট হয়েছিল, সেখানে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল।

২০১৬ সালে এই গোষ্ঠীর নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি প্রকাশ্যেই আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন এবং জাবাত আল-নুসরাকে বিলুপ্ত করে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। এর নামই রাখা হয় হায়াত তাহরির আল-শামস এবং পরে এর সঙ্গে আরও কিছু ছোট গোষ্ঠী যোগ দেয়।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সিরিয়ায় যুদ্ধের আগে থাকা ২ কোটি ২০ লাখ বাসিন্দার অর্ধেকের বেশি যুদ্ধ শুরুর পর পালাতে বাধ্য হন।  যুদ্ধে ৬৮ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। তাদের দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাঁবুতে বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক সেবার প্রবেশাধিকার সীমিত।  ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী। প্রতিবেশী লেবানন, জর্দান ও তুরস্ক, যারা মোট ৫৩ লাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৪
আরএইচ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।