ঢাকা, রবিবার, ৩০ চৈত্র ১৪৩১, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম ও ফিলিস্তিনিদের বেদনার ইতিহাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২৫
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম ও ফিলিস্তিনিদের বেদনার ইতিহাস

উপনিবেশবাদী পশ্চিমাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হন। তারা ভেবেছিলেন, সংকটের দ্রুত সমাধান হবে এবং তারা শিগগিরই নিজেদের ঘরে ফিরতে পারবেন।

কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তনের পথ আর কখনোই উন্মুক্ত হয়নি। জায়নবাদী ইসরায়েল তাদের আর ঘরে ফিরতে দেয়নি।

একসময় যে হুইদীরা শরণার্থী হয়ে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে এসেছিল আশ্রয় নিতে। একসময় তারাই আবির্ভূত হয় দখলদার ও নিপীড়ক হিসেবে। এখন সেই দখলদাররা ফিলিস্তিনিদের তাদের আপনভূমি থেকে বিতাড়িত করে গড়ে তুলেছে ইহুদী বসতি। এই দখলদারিত্বেরই অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলছে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা। জাতিসংঘেরই মতে, ওই অঞ্চলটি শিশুদের গোরস্থানে পরিণত হয়েছে।

ইহুদী জাতির নেতারা বলে থাকেন, ১৮৯৭ সাল থেকেই নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিলেন তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বর্বরতার শিকার ইহুদীরা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সেই সহানুভূতির সুযোগ নিয়ে ব্রিটেন-আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের প্রশ্রয়ে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নামে।

ব্রিটিশ শাসন ও বেলফোর ঘোষণা

১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল ব্রিটেনের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বাহিনী তুরস্কের কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে নেয়। ওই বছরই ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর এক চিঠির মাধ্যমে ইহুদী নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে জানান—ব্রিটেন ফিলিস্তিনে একটি ইহুদী রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করবে। এই চিঠিই ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত।

তখন ফিলিস্তিনে ইহুদী জনগোষ্ঠী ছিল নগণ্য। কিন্তু ইউরোপজুড়ে ইহুদীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সহিংসতা তাদের মাঝে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের চাহিদা জোরালো করে তোলে।

নাৎসি নিপীড়ন ও অভিবাসনের ঢল

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের ক্ষমতায় আসার পর ইহুদীদের ওপর দমন-নিপীড়ন শুরু হয়। হাজার হাজার ইহুদী তখন পালিয়ে এসে ফিলিস্তিনে আশ্রয় নিতে থাকে। এতে ফিলিস্তিনিরা তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন মনে করে বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সেনা ও ইহুদী বসতি।

ব্রিটিশ বাহিনী ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে, ফলে আরব সমাজে বিভক্তি তৈরি হয়। এ সুযোগে ইহুদীরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠিত হতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সূচনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী নিধনের ভয়াবহতা আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়ে নেয়। যুদ্ধ শেষে বিশ্বমঞ্চে প্রশ্ন ওঠে, যেসব ইহুদী বেঁচে গেছেন তাদের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান দ্রুত এক লাখ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে পুনর্বাসনের আহ্বান জানান।

ব্রিটেন আশঙ্কা করছিল, এত বিপুল সংখ্যক ইহুদীর আগমনে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। কারণ, এ সময় ইহুদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশ সেনাদের লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা চালাতে থাকে। ব্রিটেন পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বিষয়টি জাতিসংঘে তোলে।

জাতিসংঘের বিভাজন প্রস্তাব ও আরবদের প্রতিক্রিয়া

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদী রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্র। যদিও ইহুদীরা তখন মাত্র ১০ শতাংশ জমির মালিক ছিল, তবু তাদের মোট জমির অর্ধেক দিয়ে দেওয়া হয়।

ফিলিস্তিনি ও আরবরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ইহুদীরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠে। এ সিদ্ধান্তের পর থেকেই শুরু হয় দাঙ্গা। ব্রিটিশ বাহিনী ফিলিস্তিন ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

যুদ্ধের সূচনা ও আরব পরাজয়

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ বাহিনী ফিলিস্তিন ছেড়ে গেলে ইহুদী নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। এক ঘণ্টার মধ্যে মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া—এই পাঁচ আরব দেশ ইসরায়েল আক্রমণ করে। আরবদের সেনাসংখ্যা ছিল ৩০ হাজার, ইসরায়েলের ছিল ৩৫ হাজার।

কিন্তু আরবদের মধ্যে নেতৃত্বের অভাব, সমন্বয়ের অভাব ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে তারা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইহুদীদের ছিল সুসংগঠিত পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা। যুদ্ধের মাঝখানে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে আধুনিক অস্ত্র পায় ইসরায়েল।

যুদ্ধবিরতির সময় ইসরায়েল নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে এবং যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে তারা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়।

যুদ্ধের পরিণতি

১৯৪৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চলা এ সংঘাতে প্রায় ছয় হাজার ইহুদী নিহত হয়। ইসরায়েলিরা মনে করে, তারা যদি সে যুদ্ধে হেরে যেত, তাহলে আরবরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিত।

আজো অনেক ইসরায়েলি মনে করেন, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ যে দুটি রাষ্ট্রের প্রস্তাব দিয়েছিল তা ফিলিস্তিনিরা মেনে নিলে হয়তো আজ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুটি দেশ শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি অবস্থান করত।

তবে ঐতিহাসিকরা বলেন, ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের মূল কারণ ছিল নেতৃত্ব ও ঐক্যের অভাব। আর এই পরাজয়ই ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মকে স্থায়ী করে তোলে।

এক নথি থেকে জানা যায়, ১৯৩০-এর দশকে পোল্যান্ড থেকে আগত ইহুদীরা গাজার সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে একটি কৃষিভিত্তিক বসতি স্থাপন করে। ‘কিবুটস’ নামে পরিচিত এসব বসতি ছিল মূলত যৌথ খামার। এই অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি আরবরাও কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। তখন ইহুদী ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মোটামুটি সহনশীল।

কিন্তু পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায় একই দশকে, যখন ফিলিস্তিনিরা দেখতে শুরু করে—তাদের আশপাশের জমি একে একে ইউরোপ থেকে আগত ইহুদীদের হাতে চলে যাচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনের ছায়ায়, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সহায়তায় এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক কৌশলে, ইহুদীরা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে থাকে। এর কিছুদিন পর আসে বেলফোর ডিক্লারেশন। এটি ছিল ফিলিস্তিনি আরবদের ইচ্ছা ও পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র নির্মাণের নীলনকশা।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদীদের জন্য এবং অন্যটি ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য। এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলের জন্য বরাদ্দ হয় ৫৫ শতাংশ জমি, যেখানে ফিলিস্তিনিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং জমির অধিকাংশ মালিক। আরবরা এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর শুরু হয় সশস্ত্র সংঘর্ষ।

১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণার পর আরব দেশগুলো যুদ্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু অসংগঠিত আরব বাহিনীর বিপরীতে সুসংগঠিত ও অস্ত্রে সজ্জিত ইহুদী বাহিনী একের পর এক আরব গ্রাম দখল করতে থাকে। এই সময়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। গণহত্যা, ধর্ষণ ও ভয়াবহ সহিংসতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হয়—যাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয় বলে অভিহিত করে।

বাস্তুচ্যুতির সাত দশক: এক জাতির ক্রমাগত দুর্দশা

১৯৪৮ সালে যে ৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল, তাদের বর্তমান সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ লাখে। তারা আজো বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিশেষত গাজা, পশ্চিম তীর, জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় বসবাস করছে শরণার্থী শিবিরে—কোনো নাগরিকত্ব নেই, নেই মৌলিক অধিকার, নেই স্বদেশে ফেরার নিশ্চয়তা।

গাজায় এখন যারা বাস করছে, তাদের প্রায় সবাই সেই উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সন্তান বা নাতি-নাতনি। সেখানে মানবিক পরিস্থিতি আজ চরম অবনতির দিকে। স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল, শিক্ষা, নিরাপত্তা—কোনো কিছুই নেই বললেই চলে। ইসরায়েলি অবরোধ, দফায় দফায় বোমাবর্ষণ ও স্থায়ী অনিশ্চয়তা তাদের জীবনকে করে তুলেছে বন্দিত্বের সমান।

ইতিহাস যা বলে, আর ভবিষ্যৎ যা চায়

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা একপাক্ষিক বিজয়ের গল্প হলেও, ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি এক দীর্ঘ, অব্যাহত হারানোর ইতিহাস। রাষ্ট্র না থাকলে কোনো জাতির স্বপ্ন, অধিকার ও ভবিষ্যৎও থাকে না—এটাই ইতিহাসের নিষ্ঠুর সত্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২৫
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।