ঢাকা, বুধবার, ৪ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ জুন ২০২৫, ২১ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্প কি ইরানে হামলার অনুমোদন দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র কি যুদ্ধের পথে?

মো. জুবাইর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৩০, জুন ১৮, ২০২৫
ট্রাম্প কি ইরানে হামলার অনুমোদন দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র কি যুদ্ধের পথে? ডোনাল্ড ট্রাম্প, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করার প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একেকবার একেক কথা বলছেন। মিশ্র বার্তা দিচ্ছে তার প্রশাসনও।

এমন পরিস্থিতি প্রশ্ন একটাই— যুক্তরাষ্ট্র এখনো কি কূটনৈতিক সমাধানে অঙ্গীকারবদ্ধ, নাকি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া নানা পোস্টে বারবার কূটনৈতিক চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন ট্রাম্প। প্রথমবার তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেন গত বৃহস্পতিবার। সেদিন নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছিলেন, ‘উই রিমেইন কমিটেড টু অ্যা ডিপ্রোমেটিক রিসলিউশন’। অর্থাৎ, ‘আমরা কূটনৈতিক সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।  

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানি আলোচকরা ওই সপ্তাহে পুনরায় আলোচনার পরিকল্পনা করছিলেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু এর মাত্র মাত্র ১৪ ঘণ্টা পর ইরানে অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। সে সময় ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান, চুক্তিতে পৌঁছাতে তিনি ইরানকে ৬০ দিনের সময় দিয়েছিলেন। সেটি শেষ হয়ে গিয়েছে।  

গত রোববার তিনি লেখেন- ‘ইসরায়েল ও ইরান একটি চুক্তি করবে এবং আমার মাধ্যমে সেটা সম্ভব হবে। ’

গত সোমবার কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেন ট্রাম্প। সম্মেলনের মাঝেই তিনি কানাডা ছেড়ে ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তখন জানান, বিশেষ কিছু এটা হতে চলেছে। পর মুহূর্তেই তিনি আবার বলেন, ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে না। সবাইকে অবিলম্বে তেহরান থেকে সরে যেতে হবে!’

এরপর আবার তিনি জানান, জি-৭ সম্মেলন ছেড়ে তার দেশে ফিরে আসার উদ্দেশ্য যুদ্ধবিরতি নয়, বরং এর চেয়ে অনেক বড় কিছু।

এর মাঝেও তিনি ট্রুথ সোশ্যালে বিভিন্ন পোস্ট দেন। সবগুলোতেই তিনি তার বলা বাক্যের পরিবর্তন করেছেন।  

বারবার নিজের কথার এমন পরিবর্তনে প্রশ্ন ওঠে, ট্রাম্প কি ইরানে হামলার পরোক্ষ অনুমোদন দিয়েছেন? কিন্তু ট্রাম্প যেমন বলেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিষয়টি অনেকটা ‘উইঙ্ক অ্যান্ড নড’, মানে চুপি চুপি সম্মতি দেওয়া।  

ইরানে ইসরায়েলের হামলার দ্বিতীয় দিন গত রোববার তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন— ইরানে আজ রাতে হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এরমধ্যেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় হামলার পরিকল্পনায় ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত হওয়ার কথা বিবেচনা করছেন ট্রাম্প।

ইরানের যে কটি পারমাণবিক স্থাপনায় সম্ভাব্য হামলার কথা ভাবা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ফোর্দো’ পারমাণবিক স্থাপনা। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়। তবে ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের মধ্যে এই পরিকল্পনা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে এবং এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

হোয়াইট হাউস জানায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি চলে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। বৈঠক শেষে ট্রাম্প কোনো মন্তব্য করেননি এবং প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকেও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

বিশ্লেষকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যারামস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের নন-প্রোলিফারেশন নীতির পরিচালক কেলসি ড্যাভেনপোর্ট বলেন, ট্রাম্প সবসময় কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং সামরিক হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি রিপোর্টে আছে, তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।

তবে ইতিহাসবিদ ও স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি আনসারি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি না জানলেও হামলার বিষয়ে সচেতন ছিল। তারা হয়তো নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে অবগত ছিল না, তবে ঘটনাটি পূর্বানুমিত ছিল। ‘উইঙ্ক’ শব্দটাই যথার্থ।

এই পরিস্থিতিতে আরেকটি বড় প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্র ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কিনা? এখনও স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও, পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই এই সংঘাতে জড়িত। কেননা, দেশটি চায় না ইরান পারমানবিক শক্তিধর হয়ে উঠুক।  

ইসরায়েল ইরানের নাটানজ পারমাণবিক স্থাপনায় উপরিভাগের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অংশ ধ্বংস করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দো এখনও ‘অক্ষত’। স্থাপনাটি একটি পর্বতের নিচে এবং এটি ইউরেনিয়ামকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে সক্ষম।  

ড্যাভেনপোর্টের মতে, ইসরায়েলের পক্ষে ফোর্দোর মতো গোপন স্থাপনাগুলোর ক্ষতি করা সম্ভব নয়, যদি না যুক্তরাষ্ট্র তার ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ম্যাসিভ ওরডন্যান্স পেনিট্যাটোর বোমা সরবরাহ করে। যদিও এখনো পর্যন্ত সেই অস্ত্র হস্তান্তর করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বারবারা স্ল্যাভিনও মনে করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস করতে ইসরায়েলকে মার্কিন অস্ত্র সহায়তা প্রয়োজন।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড নেফিউ বলেন, ট্রাম্প বরাবরই বিজয়ীদের পাশে থাকতে পছন্দ করেন। বর্তমানে তিনি ইসরায়েলকে ‘বিজয়ী’ ভাবছেন বলেই পরোক্ষভাবে তাদের সহায়তা করছেন।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক মাঝ-আকাশে জ্বালানি সরবরাহকারী বিমান পাঠিয়েছে, ইউএসএস নিমিটজ রণতরী মোতায়েন করেছে এবং অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছে।

অধ্যাপক আনসারি বলেন, ট্রাম্প নিজের ‘গৌরব’ পেতে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিকভাবে জড়াতে পারেন। এমন হুমকিই ইরানকে আলোচনায় বসাতে বাধ্য করতে পারে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মানরক্ষা করে চুক্তি করতে পারে, তবে ইসরায়েলের সঙ্গে নয়।

এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন সিনেটর টিম কেইন সোমবার একটি ওয়ার পাওয়ারস রেজল্যুশন উত্থাপন করেছেন, যার ফলে ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন আবশ্যক হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ) চুক্তি অনুসারে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (আইএইএ) দ্বারা নজরদারির আওতায় আসে। ওই চুক্তি কূটনৈতিক পথের প্রতীক ছিল। তবে ট্রাম্প ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে জেসিপিওএ থেকে সরিয়ে নেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপই বর্তমান উত্তেজনার মূল কারণ।

রিচার্ড নেফিউ বলেন, এই চুক্তি ধ্বংস করাই বর্তমান সংকটের দিকে নিয়ে এসেছে। সামরিক চাপ বরং দেশগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্রে আকৃষ্ট করে। তারা ভাবে, আমার নিরাপত্তার জন্য এটিই একমাত্র পথ।

ড্যাভেনপোর্টও মনে করেন, ইরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হলেও সমস্যা থেকে যাবে। এমনকি সেখানে যদি গণতান্ত্রিক সরকার আসে, তারাও পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র এখনও সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। তবে ট্রাম্পের অস্পষ্ট বার্তা, ইসরায়েলের আগ্রাসী কৌশল, এবং পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে উত্তেজনা এ অঞ্চলে এক নতুন সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামী সপ্তাহগুলোয় কূটনীতির কতটা অগ্রগতি সম্ভব তার ওপর।

আলজাজিরা অবলম্বনে

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।