মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ছড়িয়ে পড়া ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ উত্তেজনা এক অনিশ্চিত পথে এগোচ্ছে। দুই রাষ্ট্রই সরাসরি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের প্রবণতা, আকাশপথে দখলদারি এবং সাইবার ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ব্যবহার পরিস্থিতিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও, ইরানের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা, বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড এবং যুদ্ধাবস্থায় অভ্যস্ত সমাজ। এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ কেবল সামরিক সক্ষমতার তুলনায় নয়—রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও করা প্রয়োজন, যাতে বোঝা যায় এই যুদ্ধ কীভাবে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারে।
এই সংঘাত নিয়ে দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক মুহানাদ সেলুম বলেন, এই যুদ্ধে প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইসরায়েল এগিয়ে থাকলেও ইরানের রয়েছে আরও বহু কৌশলগত শক্তি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল প্রায় পুরোপুরি ইরানের আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, কিন্তু ইরানের আয়তন ইসরায়েলের তুলনায় ৭০ গুণ বড়।
ইরানিরা অনেক আঘাত সহ্য করতে পারে। কিন্তু তাদের নিজস্ব কিছু অস্ত্র রয়েছে, যা ইসরায়েলকে আঘাত করতে পারে। এবং ইসরায়েলের এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। তারা হয় নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করুক, নয়তো অবশ্যই একটি নির্ণায়ক বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখন এই সংঘাতের এক সংকটময় পর্যায়ে পৌঁছেছি যদিও এখনো দুই দেশ এটিকে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, কিন্তু তারা উভয়েই ক্রমশ তাদের অস্ত্র প্রয়োগের তীব্রতা বাড়িয়ে চলেছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস নেতৃত্বাধীন আক্রমণের সময়ই প্রমাণ হয়েছিল, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া করা সম্ভব— এখন ইরানিরাও সেই একই কৌশল ব্যবহার করছে। যদি এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, সেটা ইসরায়েলের পক্ষে ভালো হবে না। কারণ অধিকাংশ ইসরায়েলি এখন বাঙ্কারে অবস্থান করছে, তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে, সেলুম বলেন, ইরান গত ৪০ বছর ধরে একপ্রকার জরুরি পরিস্থিতিতে রয়েছে— ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর থেকেই। তাদের রয়েছে লেবানন ও সিরিয়ায় সক্রিয় মিলিশিয়া, কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখে থেকেও তারা একটি আলাদা ধরনের অর্থনীতি পরিচালনা করে। তাই আমরা এখন এমন দুটি দেশের মুখোমুখি অবস্থান দেখছি, যারা একে অপরের থেকে একেবারেই ভিন্ন, কিন্তু একে অপরকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোহরেহ খারাজমি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানেন যে, ইরানের কাছে হাজার হাজার বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে এবং তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর প্রবল আক্রমণ চালাতে সক্ষম।
তিনি বলেন, ট্রাম্প নিজেও এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন, একবার বলেন ঢুকবেন, আবার বলেন না। আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ জনের মধ্যে ৮ জন যুদ্ধ চান না, তারা কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে।
খারাজমি বলেন, আমি মনে করি, যদি পশ্চিমা দেশগুলো, চীন, রাশিয়া এবং আরব রাষ্ট্রগুলো আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন হয়, তাহলে প্রকৃত অর্থে একটি কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব।
এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাত উপসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বড়সড় ধাক্কা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, যুদ্ধ যত দীর্ঘ হয়, তত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
গারগাশ আরও বলেন, উত্তেজনা প্রশমন এখন "চরম গুরুত্বপূর্ণ" এবং এই সমস্যাগুলোর সমাধানে আলোচনার পথ খোলা আছে। এই যুদ্ধ সেই আঞ্চলিক কাঠামোর বিরুদ্ধে যাচ্ছে, যেটা উপসাগরীয় দেশগুলো গড়ে তুলতে চায়— যার মূল লক্ষ্য আঞ্চলিক সমৃদ্ধি। আমরা মনে করি এই সংঘাত আমাদের শুধু আমিরাতকে নয়, গোটা অঞ্চলকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা
এমএম